বুঝে অথবা না বুঝে আইন বাতিল চাই যারা তাদেরও জানা দরকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল নয়, সংশোধন দরকার। আমরা যারা আইনজ্ঞ, সাধারণ পিউপিল, পাবলিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চাচ্ছি তাদের মধ্যে ক’জন আইনটি পড়ে কিংবা বাংলাদেশের পরিপেক্ষিত বিবেচনা করেছি তা আমার আন্দাজে ধরে।
২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণীত হয়েছিলো আবার একই ধাচের সংশোধিত পরিবর্ধিত জিনিস ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে অব্যহতি দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনকে তথা বিতর্কিত ৫৭ ধারাকে।
না না, আইন প্রণয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। আইনের ধর্ম বদলে যাওয়া, সময়ের সাথে সাথে সমাজে বসবাসরত মানুষদের আচার-আচরণের উপর আইনকে তার গতিবিধি পরিবর্তন করতে হয়।
তবে বাংলাদেশের একবিংশ শতকের প্রণীত আইনগুলো বোধহয় একটু দ্রুত চরিত্র পরিবর্তন করে বা করতে হয়। মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, যারা পুরো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনখানা বাতিল চেয়ে আন্দোলন করছেন তারা কোন যুক্তিতে পুরো আইনখানা বাতিল চাচ্ছেন আমার বুদ্ধিতে কাজ করছে না।
তবে হ্যা, এটা সত্য যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধিকাংশ ধারা সংবিধান পরিপন্থী এবং বাংলাদেশ দ্বারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন থ্রিটি এবং চার্টার স্বীকৃত আর্টিকেল পরিপন্থী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একটি আইনের বেশ কিছু ধারা জনহিতকর না হলে কিংবা গণমানুষের কল্যাণে না হলে পুরো আইনটি বাতিলের আন্দোলন করাটা আমাদের আন্দোলনকারীদের জন্য সুখকর কিনা?
কিংবা এমন প্রশ্নও হতে পারে যে, পুরো আইনটি বাতিল হলে আবার আমাদের গণমানুষের অকল্যাণ হবে কিনা? তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত পুরো আইনের নাম ধরে বেইজ্জতি করে আইনখানা বাতিল চেয়ে আন্দোলন করলে আন্দোলন অতি দ্রুত বেগবান হবে, যেটা কয়েকটা ধারা বাতিল চেয়ে করলে না হতে পারে।
পুরো আইনটি বাতিল এই কারণেই করা যাবে না কারণ একই আইনে, হ্যাকিং, চুরির মতো অপরাধের বর্ণনা ও শাস্তিও বর্ণিত রয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট,২০১৮ এর ধারা ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ২৪, ৩০, ৩৪ ধারাগুলো বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বলবৎ রাখা জরুরি বটে।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবিধানবিরোধী ধারা কিংবা স্বাধীন মতপ্রকাশে গলার কাঁটা হয়ে থাকা ধারা কোনগুলো। এ বিষয়ে আমার প্রথম উদ্বেগ হলো ৪৩ ধারায়, এ ধারায় পরোয়ানা ব্যতিত উল্লিখিত আইনের অপরাধে পুলিশ জব্দ, তল্লাশি ও গ্রেফতার করতে পারবে, যা কাম্য নয় এবং একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য হয়রানিমূলক।
ধারা ৫৩ একইভাবে অনেকটা ইক্যুয়ালিটি অব জাস্টিস এর পরিপন্থী, এই ধারায় এই আইনের প্রায় ১৪ টি ধারা অ-জামিনযোগ্য বলা আছে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার যা অবস্থা, সে নিয়ে চিন্তা করলে এসব অপরাধে অ-জামিনযোগ্যতা অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিতে হুমকিস্বরূপ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১,৩২ ধারায় বর্ণিত অপরাধসমূহ এবং অত্যাধিক শাস্তি মূলত সংবিধান পরিপন্থী এবং স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এই ধারাগুলোর সুনির্দিষ্ট বর্ণনা না থাকায় বর্তমানে এগুলো ব্যবহার হচ্ছে সুশীল এবং প্রগতিশীল লেখক-কার্টুনিস্টদের বিরুদ্ধে।
নিরাপত্তা আইন বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে আগের ২০১৩ সালের আইসিটি এক্ট এর ৫৭ ধারাকে ভেঙে আরো নতুনভাবে কয়েকটি ধারায় শাস্তি বাড়িয়ে এবং দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে স্বাধীন মত প্রকাশের কণ্ঠকে রোধ করার একটা সু-চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিদিন কয়েকটি মামলা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারায়, এক ধরণের সরকার সমালোচনার দমন-পীড়ন হচ্ছে দেশে।
বেশিরভাগ মামলার বাদী সরকার দলীয় লোকজন আর আসামী বিরোধীদলীয় লেখক-সমালোচক-কার্টুনিস্টগণ। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কিছু মানুষ যেভাবে মামলাবাজ হয়ে পড়েছে, এ লক্ষণ শুভ লক্ষণ নয়।
সুতরাং, আইনটি সম্পূর্ণ বাতিল নয়, বিতর্কিত এবং সংবিধানবিরোধী স্বাধীন মত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত করা ধারাগুলো বাতিল জরুরি হয়ে পড়েছে। আইন জনমানুষের কল্যাণের জন্য, কোন দলকে সরকারের জায়গায় ভোটহীন যুগ যুগ টিকিয়ে রাখার অস্ত্র বানানোর জন্য নয়।
দেশের আইনবিদ, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী, বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অচিরেই এই আইন সংশোধন করা হোক এবং গণমাধ্যমসহ স্বাধীনভাবে লেখা ও আঁকার অধিকার নিশ্চিত করা হোক। এভাবে চলতে থাকলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হবে না এর নিশ্চয়তা দিবে কে?