আমরা কম-বেশি সকলেই জানি ১২ বছর দখলে থাকলেই সম্পত্তিতে অধিকার সৃষ্টি হয়। তামাদি আইনের ২৮ ধারা মতে এডভার্স পজেশনের মাধ্যমে এই অধিকার বিলুপ্ত হয়। লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্স অনুযায়ী নিজের অধিকারের জন্য সবসময় তৎপর হতে হবে। আর আইন কখনো নিজে থেকে কোন প্রতিকার দেয় না, প্রতিকার চাইতে হয়। আজকের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করবো কিভাবে একটি সম্পত্তি থেকে আপনার অধিকার বিলুপ্ত হতে পারে। তামাদি আইন অনুযায়ী একটি নিদির্ষ্ট সময় পর আপনার সম্পত্তি থেকে আপনার অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
Table of Contents
তামাদি আইনের বিশ্লেষণ
তামাদি অর্থ হলো বিলুপ্ত বা বন্ধ হওয়া। তামাদি আইনের মাধ্যমে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত আইনি জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে তামাদি আইন। তামাদি আইন এই নীতির উপর প্রতিষ্টিত যে, আইন পরিশ্রমীদের সাহায্য করে, অলসদের নয় (The Law aids the diligent and not the indolent)। কোন ব্যক্তি যদি তার অধিকারের বিষয়ে অলসতা বা অবহেলা করে তাহলে আইন তাকে পরবর্তীতে কোন প্রতিকার দিবে না।
এক কথায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাতে কোন ঘটনার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয় এবং শেষ হয় ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে সে জন্যই এই আইনের উদ্রেগ।
তামাদি আইনের ২৮ ধারা
তামাদি আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন সম্পত্তির দখলের জন্য কোন ব্যক্তির মামলা দায়ের করার জন্য এই আইন দ্বারা যে মেয়াদ নির্ধারিত করে দেওয়া আছে, সে সময়ের মধ্যে যদি মামলা না করা হয় তাহলে সেই সম্পত্তিতে ঐ ব্যক্তির অধিকার বিলুপ্ত হবে। এই ধারা বুঝতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা ও তামাদি আইনের ১৪২ অনুচ্ছেদ দেখতে হবে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারায় সুনির্দিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে বলা হয়েছে এবং তামাদি আইনের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে ৮ ধারায় সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের মামলা করতে হবে বেদখলের তারিখ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তবে আপনার দখলে থাকা কোন সম্পত্তি যদি কেউ জোর করে দখলে নিতে চায় তখন আপনি চাইলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মানে জমিতে প্রবেশে বাঁধার আদেশ আনতে পারেন।
সুতরাং এবার তামাদি আইনের ২৮ ধারা পর্যালোচনা করলে ষ্পষ্টত বুঝা যায় যে আপনি কোন জমি থেকে বেদখল হলে বেদখলের বারো বছরের মধ্যে যদি সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের মামলা না করেন তাহলে সে সম্পত্তি থেকে আপনার অধিকার হারাবেন।
যেভাবে সম্পত্তির অধিকার বিলুপ্তি হতে পারে
মূলত তামাদি আইনের ২৮ ধারার মূল বিষয়বস্তু হলো দখলসূত্রে জমির মালিকানা অর্জন। তামাদি আইন দলিল ছাড়া মালিকানা, অধিকার ও স্বত্ত্বের সৃষ্টি করে থাকে। সাধারণত দুইভাবে মালিকানা অধিকার বা স্বত্ত্বের বিলুপ্তি ঘটে।
১. বিরুদ্ধ দখল (Adverse possession)
অন্যের মালিকানা অস্বীকার করে যখন কোন সম্পত্তি কেউ সবার সম্মুখে একটানা দীর্ঘদিন প্রকৃতভাবে দখলে থাকে তখন তাকে বিরুদ্ধ দখল বলে। কোন সম্পত্তিতে মালিক ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তি যদি অপ্রতিরোধ্য ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১২(বারো) বছরের বেশি সময় ধরে দখলে ও ভোগ করতে থাকে তখন ঐ সম্পত্তিতে বিরুদ্ধ দখলজনিত স্বত্ত্ব তৈরি হয়।
পাশাপাশি বারো বছর ধরে বেদখল হওয়ার পরেও যদি প্রকৃত মালিক কোন প্রকার মামলা না করে তখন সে সম্পত্তি থেকে তার অধিকার হারিয়ে ফেলে। ডালিমন নেছা বেওয়া বনাম মো: হাসমত আলী (৬১ ডিএলআর, এডি ৮) মামলায় বিরুদ্ধ দখল দ্বারা স্বত্ত্ব বা মালিকানা অর্জনের কথা বলা হয়েছে। এই মামলার রায়ে বলা হয়েছে, “রেকর্ডে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিবাদীগণ নালিশী জমিতে ১২ বছরের অধিককাল অধিকার হিসেবে দখলে আছে এবং বাদী বা তাদের পূর্বাধিকারীরর প্রতিকূলে বিরুদ্ধ স্বত্ব দাবী করে এবং তারা পুরোপুরিভাবে বহিস্কৃত হয়েছিল এবং এভাবে বাদীর অধিকার, স্বত্ত্ব ও স্বার্থ, যা তারা ঐ সম্পত্তিতে অর্জয় করেছে বলে দাবী করেছে তা বিরুদ্ধ দখল দ্বারা বিলুপ্ত হয়েছে এবং বিবাদীগণের অনুকূলে বিরুদ্ধ দখলজনিত স্বত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে।” এজন্য বলা যায়, দীর্ঘকালীন দখল সম্পত্তিতে মালিকানা, অধিকার ও স্বত্ত্ব সৃষ্টি করে, কোন দলিলের প্রয়োজন হয়না।
২. ব্যবহারস্বত্ব (The right of easement)
তামাদি আইনে ২৬ ও ২৭ ধারায় ব্যবহারস্বত্ব বা easement এর বিষয়ে বলা হয়েছে। ব্যবহারস্বত্ব মানে হলো কোন স্থলপথ, পানি বা জলপথ, আলো, বাতাসের দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অধিকার। অনাবশ্যক ছাড়া কোন জমির ক্ষেত্রে ব্যবহারস্বত্ব সৃষ্টি হয়না।
উক্ত ধারায় আরও উল্লেখ আছে ব্যবহারস্বত্ব সৃষ্টির জন্য ব্যবহার বা ভোগদখল প্রকাশ্য ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। তবে ব্যবহারস্বত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে সাধারণ সম্পত্তিতে একটানা ২০ (বিশ) বছর ব্যবহার করতে হবে এবং সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে একটানা ৬০(ষাট) বছর যাবৎ ব্যবহার করতে হবে।
আইন বিজ্ঞানী স্যামন্ডের মতে যৌক্তিক ভিত্তি হলো দখল ও মালিকানা সব সময় একত্রে থাকার অনুমান। দখল হলো মালিকানার সাক্ষ্য। কোন সম্পত্তির মালিক সম্পত্তির দখলে না থাকলে অনুমান করা হয়, তিনি মালিক নয়। আবার দখলদারকে মালিক বলেও ধারণা করা হয়।
জবর দখল (Forceful possession) এর মাধ্যমে সম্পত্তিতে অধিকার সৃষ্টি হয় না
যদি কেউ সংঘাতপূর্ণভাবে বা জোর করে অন্যের সম্পত্তি দখল করে তাহলে তাকে জবর দখল বা forceful possession বলে। আইনের দৃষ্টিতে জবর দখল সম্পূর্ণ অবৈধ। কোন সম্পত্তি কেউ জোর করে দখল করে একটানা ১২ বছর ভোগ দখলে থাকলেও সে সম্পত্তিতে তার অধিকার সৃষ্টি হবে না।
সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে জবর দখল ও বিরুদ্ধ দখল উভয়েই অন্যের সম্পত্তিতে দখল। কিন্তু পার্থক্য হলো বিরুদ্ধ দখলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট সময় পর একধরণের অধিকার সৃষ্টি হয় আর জবর দখল করা সম্পত্তিতে কখনো অধিকার সৃষ্টি হয়না।
জবর দখল মূলত ভয় দেখিয়ে বা শক্তি প্রয়োগ করে অথবা প্রকৃত মালিককে ভয় দেখিয়ে গোপনে হতে পারে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিরুদ্ধ দখলকারী ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতে তামাদি আইনের ২৮ ধারায় মামলার মাধ্যমে অধিকার দাবী করতে পারে এবং এর আইনি ভিত্তিও আছে কিন্তু জবর দখলকারী কোন ব্যক্তি কোন সম্পত্তির অধিকারের জন্য আদালতে মামলা করতে পারেন না।
সুতরাং, কেউ যদি সম্পত্তি জোর করে জবর দখল করে নেয় সেক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করার বিধান রয়েছে।
কেস রেফারেন্স
তামাদি আইনের ২৮ ধারা নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক মামলা হয়েছে এবং নিষ্পত্তিও হয়েছে। দেশব্যাপী এই ধারার পক্ষে-বিপক্ষে আছে নানান সমালোচনা। এই ধারার অধীন নিষ্পত্তিকৃত কিছু মামলার রায় দেখা যাক।
৫৯ ডিএলআর, এডি ২১০ এই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বাদী-প্রতিপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, মামলা করার পূর্বে ১২ বছরের অধিককাল তিনি নালিশী সম্পত্তিতে দখলে ছিলেন, যা বিবাদী-প্রতিপক্ষের প্রতিকূলে বিরুদ্ধ দখল দ্বারা নিশ্চিত করেছে।
৫২ ডিএলআর, এডি ১২১ মামলায় বলা হয়েছে অনুমতিতে দখল, সে যতই দীর্ঘ হোক না কেন দখলকারী বা তার উত্তরাীদকারগণের উপর কোন স্বত্ব প্রদান করেনা। হই সুন্দরভাবে প্রতিষ্টিত যে, যখন অনুমতি নিয়ে দখল শুরু হয় তখন হইা বিরুদ্ধ হবে না, যদি না বিরুদ্ধ হওয়ার মত কিছু সুনির্দিষ্টভাবে করা হয়- উত্তরাধিকারের হাতে, এমনকি আসল অনুমতি দখলকারের হাতে।
এরকম আরও বহু মামলার রায়ে আদালত নিজস্ব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এসব মামলার রায় নিম্ন আদালতের জন্য প্রিসিডেন্ট বা নজির হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
শেষ কথা
কোন ব্যক্তি যদি একাদিক্রমে দীর্ঘদিন অন্যের সম্পত্তিতে প্রতিবন্ধহীনভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় তাহলে দীর্ঘকালীন ভোগদখলজনিত অধিকারের উদ্ভব হয়। আর এভাবে অন্যের সম্পত্তিতে অধিকার অর্জন করা যায়। আবার প্রকৃত মালিক দীর্ঘদিন সম্পত্তির দখলে না থাকলে সম্পত্তিতে তার অধিকার ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়। এজন্য বলা হয়, তামাদি আইন শুধুমাত্র অধিকার বিলোপ করেনা, অধিকার বা স্বত্ত্বের সৃষ্টিও করে থাকে।
সুতরাং সম্পত্তি বেদখল হলে বা দীর্ঘদিন ধরে অন্যের দখলে থাকলে তা উদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট তামাদি মেয়াদের মধ্যে দেওয়ানী আদালতে মামলা দয়ের করতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার ও বেদখল হওয়া সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধারের কথা বলা আছে।
রেফারেন্স:মো: আব্দুর রহমান হাওলাদার ‘তামাদি আইনের বিশ্লেষণ’ হাওলাদার প্রকাশনী (প্রথম সংস্করণ ২০২০)