C-07, 6th floor, Annex Bar Building, Cox's Bazar Court, Bangladesh.

shipta@LegalHome.Org

নামজারি করার সঠিক নিয়ম

নামজারি অনেকের কাছে দুর্বোধ্য একটি বিষয়। মিউটেশন অথবা নামজারি বিষয়টি প্রণয়ন করা হয়েছে ভূমির মালিকের মালিকানা নিয়ে জটিলতা এড়ানোর জন্য। যখন কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে অথবা আইনগতভাবে ভূমি বা জমির মালিকানা অর্জন করে সরকারি রেকর্ডে মালিকানার নাম হালনাগাদ করা হলো নামজারি।

নামজারি কি এবং কেন?

নামজারি বা মিউটেশন অর্থ হলো বর্তমানে থাকা খতিয়ান থেকে নতুন মালিকের নাম সংজোজন করে নতুন একটি খতিয়ান তৈরি করা। এককথায় বর্তমানে খতিয়ানে যার নাম আছে তার নামের পরিবর্তে নতুন ভূমি মালিকের নামে খতিয়ান তৈরি করা।

নামজারি যখন সম্পন্ন হয় নতুন নাম্বারে একটি খতিয়ান নতুন মালিককে দেওয়া হয়। সে খতিয়ানে নামজারীকারীর অর্জিত জমি/ভূমির সংক্ষিপ্ত বিবরণী উল্লেখ থাকে।

খতিয়ানে নতুন মালিকের নাম, কোন মৌজা, মৌজার নাম্বর (জে এল নাম্বর), জরিপের দাগ নাম্বর, দাগে মোট জমির পরিমাণ, একের অধিক মালিক হলে তাদের নির্ধারিত জমির পরিমাণ ও প্রতি বছরের ধার্যকৃত খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকবে।

নামজারি বা মিউটেশন করা জরুরী কারণ জমির মালিকানা হালনাগাদ না করলে পরে নানান বিডম্বনার শিকার হতে পারেন। পরের আলোচনা থেকে নামজারি কেনো জরুরী সেটা আপনাদের পরিষ্কার ধারণা দিবে।

নামজারি বা মিউটেশনের আইনি বিধান

নামজারিকে আইনিভানে নামপত্তন বা জমাখারিজও বলা হয়। নামজারি সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ সালের ধারা-১৪৩ এর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বর্তমানে নামজারির দায়িত্ব সহকারি কমিশনার (ভূমি) এর উপর ন্যস্ত আছে যা আগে উপজেলা রাজস্ব অফিসার বা সার্কেল অফিসার (রাজস্ব) এর উপর ন্যস্ত ছিলো।

ভূমির স্বত্ত্বলিপি  পরিবর্তন ও সংশোধন জরিপের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। সার্ভে আইন, ১৮৭৫ সালে প্রণয়ন করা হয়। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৮৮৫ বিধি মোতাবেক ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সি.এস জরিপ করা হয়।

এরপরে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ প্রণয়ণ করা হয়। এই আইনের আলোকে এস.এ জরিপ ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এস.এ জরিপ পরিচালনা শেষে এস.এ রেকর্ড নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা শুরু হয়।

এই সমালোচনা পরে ১৯৬৬ সাল থেকে সরকার আর.এস জরিপ শুরু করে যা এখনো চলমান আছে। সুতরাং জরিপ ছাড়া অন্তবর্তীকালীন সময়ে ভূমির স্বত্ত্বলিপি পরিবর্তন, সংশোধন ও আপটুডেট প্রধানত জমা খারিজ, জমা একত্রিকরণ ও নামজারি সম্পাদন হয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ এর ধারা ১১৬,১১৭ ও ১৪৩ মোতাবেক।

কোন ক্ষেত্রে নামজারি করা যায়?

ক) ওয়ারিশমূলে মালিকানা অর্জন

জমির মালিকের মৃত্যুতে আইনগত ওয়ারিশ বা ওয়ারিশগণের অনুকূলে মৃত মালিকের অংশীয় জমির মালিকানা পরিবর্তিত হলে নামজারির আবেদন করা যায়। এক্ষেত্রে অংশনামা সৃজনের মাধ্যমে নামজারি হতে পারে।

খ) ক্রয়, দান, হেবামূলে মালিকানা অর্জিত হলে

রেজিস্ট্রি দলিলমূলে জমি বা ভূমি ক্রয়, দান, হেবা বা ওয়াকফ বা উইলমূলে ক্রেতা বা গ্রহীতার অনুকূলে মালিকানা হস্তান্তরিত বা পরিবর্তিত করার জন্য নামজারির আবেদন করা যায়। জমি কেনার আগে ও পরে আপনার করণীয় যে বিষয়গুলো রয়েছে তারমধ্যে নামজারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গ) জমি বন্দোবস্ত পেলে করণীয়

সরকারের নিকট থেকে কেউ খাস জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত নিলে বিধি মোতাবেক বন্দোবস্ত গ্রহীতার অনুকূলে মালিকানার পরিবর্তনের জন্য নামজারির আবেদন করা যায়।

ঘ) সরকারি অধিগ্রহণ

সরকারি প্রয়োজনে কোন সম্পত্তি অধিগ্রহণ করলে বা ক্রয় করলে সরকারের অনুকূলে মালিকানার পরিবর্তনের জন্য নামজারির আবেদন করা যায়।

ঙ) নিলামে ক্রয়

নিলাম ক্রয়কৃত জমির ক্রেতার অনুকূলে জমির মালিকানা পরিবর্তনের জন্য নামজারি হতে পারে।

চ) মালিকের স্বত্ত্ব বিলোপ

সিকস্তি বা জমিদারি উচ্ছেদ বা প্রজস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯০, ৯১, ৯২ ও ৯৩ ধারার আওতায় কোন মালিকের স্বত্ব বিলোপ হলে মালিকানা সরকারের অনুকূলে পরিবর্তিত হলে নামজারি হতে পারে।

ছ) ডিক্রিমূলে মালিকানা পেলে

স্বত্ব ঘোষণা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলার স্বত্ব ঘোষণামূলক ডিক্রি বা আদেশবলে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকানা ডিক্রি প্রাপকের অনুকূলে করার জন্য নামজারির আবেদন করা যায়।

নামজারি প্রক্রিয়া
ছবি: নামজারি প্রক্রিয়া ছকে দেখানো হলো।

নামজারি আবেদনের পদ্ধতি

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সাধারণত ৭(সাত) কারণে একজন ব্যক্তি ভূমি বা জমির মালিকানা অর্জন করতে পারে। এবং এই মালিকানা অর্জনের পর নিজ নামে খতিয়ান সৃজন করার জন্য নামজারির আবেদন করতে পারেন।

নামজারির আবেদন করার জন্য নির্দিষ্ট নামজারি ফর্ম আছে যার মাধ্যমে আপনি আবেদন করবেন। যে উপায়ে আপনি ভূমির মালিকানা অর্জন করেছেন সেসব কাগজপত্র আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।

বাধ্যতামূলক এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। তবে মালিক যদি একাধিক হয় সেক্ষেত্রে প্রত্যেকের এক কপি করে ছবি।

সর্বশেষ খতিয়ান মানে যার নিকট হতে জমি ক্রয় করেছেন বা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তার খতিয়ানের ফটোকপি। ২০ টাকা মূল্যের কোর্ট ফিস।

ওয়ারিশসূত্রে মালিকানাপ্রাপ্ত হলে অনধিক তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন থেকে ইস্যুকৃত মূল ওয়ারিশ সনদ। মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩B ধারা মোতাবেক কোন রেকর্ডিয় মালিক মৃত্যুবরণ করলে তার ওয়ারিশগণ নিজেদের মধ্যে একটি বন্টননামা সম্পাদন করে রেজিস্ট্রি করা বিধান আছে। উক্ত রেজিস্টার্ড বন্টননামাসহ নামজারির জন্য আবেদন করতে পারেন।

জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/জাতীয়তা সনদ।

ক্রয়সূত্রে জমির মালিক হলে দলিলের সার্টিফাইড ফটোকপি।

যদি একাধিকবার উক্ত জমি ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকলে সর্বশেষ যার নামে খতিয়ান হয়েছে তার পর থেকে সকল বায়া বা পিট দলিলের ফটোকপি প্রয়োজন হবে।

চলতি বঙ্গাব্দ (বাংলা সনের) ধার্যকৃত ভূমি উন্নয়ন কর (এলডি ট্যাক্স) বা খাজনার রশিদ।

আদালতের রায়ের ডিক্রির মাধ্যমে যদি জমির মালিকানা লাভ করলে উক্ত ডিক্রির সার্টিফাইড ফটোকপি প্রয়োজন হবে।

আপনি যেভাবে জমির মালিকানা প্রাপ্ত হয়েছেন তার উপর নির্ভর করবে কোন সংযুক্তি আপনার প্রয়োজন হবে। মূলত এসব কাগজপত্র একসাথে পিনাপ করে আপনার সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে নামজারির আবেদন করবেন।

নামজারি করতে কত টাকা লাগে

নামজারি করতে কত টাকা লাগে তা নিয়ে অনেকের নানান মন্তব্য আছে। মূলত আবেদন করতে প্রথমত আবেদন ফর্মটি আপনার সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে ১০ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতে পারেন। তাছাড়া ভূমি অফিস এলাকায় বিভিন্ন ফটোকপির দোকানগুলোতেও এই ফর্ম বিক্রি করা হয়।

এরপর আবেদন পত্রের সাথে বিশ টাকার কোর্ট ফিস লাগাতে হয়। যাদের নিকট থেকে মালিকানার অংশ নামজারির জন্য আবেদন করবেন তাদের নিকট নামজারির নোটিশ প্রেরণের জন্য ৫০ টাকা নোটিশ প্রেরণ ফিস।

রেকর্ড সংশোধন বা হালনাগাদ ফিস বাবদ জমা দিতে হয় ১০০০/= টাকা। মিউটেশনের খতিয়ান প্রাপ্তির জন্য দিতে হয় আরও ১০০/= টাকা। সর্বমোট নামজারি করতে সরকারি হিসেবে খরচ ১১৫০/= টাকা।

এখানে আপনাদের সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো যে, আবেদনপত্র ও কোর্ট ফিস ছাড়া বাকি ফিসগুলো ডি.সি.আর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) এর মাধ্যমে আদায় করা হয়ে থাকে।

নামজারি বা মিউটেশনের সুবিধা কি

নামজারি করার মাধ্যমে সাবেক মালিকের পরিবর্তে নতুন মালিকের নাম রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত থাকে বলে সাবেক মালিক প্রতারণার মাধ্যমে একই জমি একাধিকবার বিক্রয় করতে পারে না। যার কারণে জমি নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটে।

নতুন মালিকের নিজ নামে স্বতন্ত্র খতিয়ান সৃষ্টি হওয়ার ফলে জমির মালিকানার প্রমাণ হিসেবে সর্বক্ষেত্রে এই খতিয়ান গ্রহণযোগ্য হয়।

পাশাপাশি খারিজ খতিয়ানের উপর ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা যায়। এবং এই দাখিলা সহজে ভূমির মালিকানা ও দখল প্রমাণ করে।

গৃহ নির্মাণ, ব্যাংক ঋণ, জমি বিক্রয় প্রভৃতি কাজের জন্য নামজারি ও জমাখারিজ অধিকতর কাজে আসে। সহজে ভূমির মালিকানা প্রমাণের জন্য নামজারির বিকল্প নেই।

নামজারী আদেশমূলে সৃষ্ট সংশোধিত খতিয়ানের কপি সহকারী কমিশনারের মাধ্যমে বা ভূমি মালিকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সহকার সেটেলমেন্ট অফিসার বা জরিপকালে/ বুঝারত/ তসদিক/ আপত্তি স্তরে কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করা হলে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০’ এর ৩২০ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে জরিপ কর্তৃপক্ষ ‘সংশোধিত খতিয়ানের’ ভিত্তিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করতে পারেন।

সঠিক সময়ে নামজারি না করলে অসুবিধা

সঠিক সময়ে নামজারি বা মিউটেশন না করলে বিক্রেতা বা পূর্বের মালিক একই জমি একাধিক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করার সুযোগ পায় যার কারণে পরবর্তীতে নানান আইনি জটিলতার সৃষ্টি করে।

যৌথ খতিয়ানের জমির দখল নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। নামজারি করা না হলে নিজ নামে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা যায় না।

আমাদের পরামর্শ

বর্তমান সময়ে আদালতে মামলার সংখ্যা বিচারে ভূমি সংক্রান্ত মামলার পরিমাণ অনেকগুণে বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ মারামারি সংক্রান্ত মামলাও হচ্ছে ভূমির মালিকানা নিয়ে সংঘাতের কারণে।

সুতরাং বর্তমান সময়ে ভূমির পরিষ্কার মালিকানা নিশ্চিতের জন্য নামজারি বা মিউটেশনের কোন বিকল্প নেই। কোন জমির মালিকানা পাওয়ার সাথে সাথেই আপনার প্রথম দায়িত্ব হোক নামজারি অথবা মিউটেশন। ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র: অ্যাডভোকেট জওহরলাল দাশ, “বাংলাদেশের ভূমি আইন” হিরা পাবলিকেশন ও অন্তর্জাল।

More from the blog

ফৌজদারী মামলায় আপিল করবেন যেভাবে

ফৌজদারী মামলায় আপিল সম্পর্কে আইনে সুর্নিদিষ্ট বিধান আছে। ধরুন ফৌজদারী মামলায় একটি রায় হলো, আপনি বাদী কিংবা বিবাদী হিসেবে আদালত প্রদত্ত রায়ে সন্তুষ্ট নয়।...

কিভাবে ফৌজদারী মামলার বিচার হয়?

ফৌজদারী শব্দটি একটি ফারসি শব্দ। মূলত ফৌজ হলো আরবি শব্দ আর দারী শব্দটি ফারসি। ফৌজদারী মামলা বলতে বুঝায় যেসব কাজ করা বা না করা...

ফৌজদারী আদালতের গঠন ও বিচারিক ক্ষমতা

ফৌজদারী আদালত বলতে যে আদালতে মানবসৃষ্ট অপরাধের বিচার হয় তাকে বুঝায়। আমাদের ফৌজদারী আইনের গঠনপ্রণালী অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধকে অনেকভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং অপরাধের...

তামাদি আইনের ২৮ ধারা, বিলুপ্ত হবে সম্পত্তির অধিকার

আমরা কম-বেশি সকলেই জানি ১২ বছর দখলে থাকলেই সম্পত্তিতে অধিকার সৃষ্টি হয়। তামাদি আইনের ২৮ ধারা মতে এডভার্স পজেশনের মাধ্যমে এই অধিকার বিলুপ্ত হয়।...

You cannot copy content of this page