ফৌজদারী মামলায় আপিল সম্পর্কে আইনে সুর্নিদিষ্ট বিধান আছে। ধরুন ফৌজদারী মামলায় একটি রায় হলো, আপনি বাদী কিংবা বিবাদী হিসেবে আদালত প্রদত্ত রায়ে সন্তুষ্ট নয়। অথবা আপনার মনে হতে পারে আদালত প্রদত্ত রায়টি আপনার বিরুদ্ধে গেছে। এসব কারণে ফৌজদারী একটি মামলায় আপনি আপিল করতে পারেন। এক কথায় আপিল অর্থ উচ্চ আদালতে পুনঃবিচারের জন্য আবেদন করা।
আইন বলছে আপিল করা যায় দু’টি বিষয়ে। ঘটনার প্রশ্নে ও আইনের প্রশ্নে। নিম্ন আদালত থেকে দেওয়া কোন রায়ের বিরুদ্ধে আপনি আপিল করতে পারেন। মূলত ৩ টি কারণে আপনি একটি ফৌজদারী মামলায় আপিল করতে পারেন।
Table of Contents
কি কি কারণে আপিল করা যায়?
প্রথমে জেনে নিই একটি ফৌজদারী মামলায় কি কি কারণে আপিল করা যায়। কোন ফৌজদারী আদালত যখন কোন আসামীকে দন্ডাদেশ বা সাজার রায় দেয় আসামী হিসেবে আপনি সন্তুষ্ট না হলে তার বিরুদ্ধে আপনি আপিল করতে পারেন।
অথবা এমন হতে পারে যে, কোন ফৌজদারী মামলায় আপনি বাদী কিন্তু সে মামলায় আসামীকে খালাস দেওয়া হলো সেক্ষেত্রেও আপনি খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন।
আবার অন্যদিকে একটি ফৌজদারী মামলায় যদি আপনি বাদী হয়ে থাকেন এবং সে মামলায় আসামী একটি গুরুতর অপরাধের জন্য যে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন সে অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়নি। অর্থ্যাৎ অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশ দেওয়া হলো সেক্ষেত্রেও আপনি আপিল করতে পারবেন।
সুতরাং ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ে আপিল করা যায়।
- দন্ডাদেশ বা সাজার বিরুদ্ধে।
- খালাসের বিরুদ্ধে।
- অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে।
আইনে বিধান না থাকলে কোন আপিল চলে না। আপিলের অধিকার আইন দ্বারা সৃষ্টি।
দন্ডাদেশ বা সাজার বিরুদ্ধে আপিল
ফৌজদারী মামলার বিচারে কোন আদালত যদি দন্ডাদেশ বা সাজা দেয় আর এই রায়ে যদি আপনি সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে আপিল করতে হবে। সাজার বিরুদ্ধে আপিল সম্পর্কে জানার আগে আপনাকে একটি বিষয়ে অবশ্যই ধারণা রাখতে হবে সেটি কোন ফৌজদারী আদালতের বিচারিক এখতিয়ার কতটুকু? এবং আরও একটি বিষয় হলো ফৌজদারী মামলার বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে শুরু হয়?
এই দু’টি বিষয়ে ধারণা থাকলে আপনি আপিল সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। এ কারণে বলছি আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে কোন ফৌজদারী আদালতের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোন উচ্চ আদালতে আপিল করতে হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০৭ ধারায় বলা আছে যদি কোন ২য় বা ৩য় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তি বা দন্ডাদেশ দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
৪০৮ ধারায় বলা হয়েছে কোন যুগ্ন দায়রা জজ বা ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট দন্ডাদেশ দিলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে দায়রা জজ আদালতে। এখানে একটি শর্তও আছে। যদি কোন যুগ্ন দায়রা জজ ৫ বছরের বেশি দন্ডাদেশ দেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আপিল দায়রা জজ আদালতে করা যাবে না, করতে হবে হাইকোর্টে।
৪০৮ ধারায় আমরা জেনেছি ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কোন সাজা দিলে তার বিরুদ্ধে আপিল দায়রা জজ আদালতে কিন্তু এখানে আরও একটি ভিন্ন বিধান আছে। ৪০৮(বি) ধারায় বলা হয়েছে কোন ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা কোন ম্যাজিস্ট্রেট যদি দন্ডবিধির ১২৪(এ) ধারায় রাষ্ট্র্রদ্রোহিতার কোন মামলায় সাজা বা দন্ডাদেশ দেন তাহলে সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে হাইকোর্টে।
এবার ৪১০ ধারায় বলা হয়েছে দায়রা আদালত যদি কোন দন্ডাদেশ দেন তাহলে আপিল করতে হবে হাইকোর্টে।
খালাসের বিরুদ্ধে আপিল যেসব আদালতে
খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় শুধুমাত্র দু’টি আদালতে। দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে যেভাবে ভিন্ন ভিন্ন আদালতে আপিল করার বিধান রয়েছে খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় শুধুমাত্র দু’টি আদালতে। সাধারণত দুটি পক্ষ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করেন। পাবলিক প্রসিকিউটর বা বাদী/অভিযোগকারী।
যেকোন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত যখন খালাসের কোন রায় দিবেন তখন তার বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউটর ৬ মাসের মধ্যে এবং অভিযোগকারী নিজে করলে ৬০ দিনের মধ্যে দায়রা আদালতে আপিল করতে পারবেন।
যদি কোন দায়রা আদালত খালাসের রায় দেন তাহলে পাবলিক প্রসিকিউটর ৬ মাসের মধ্যে ও অভিযোগকারী হলে ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে হাইকোর্টে।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, পাবলিক প্রসিকিউটর মূল মামলা কিংবা আপিলে দেওয়া খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন, অর্থ্যাৎ খালাস আদেশের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউটর দ্বিতীয় আপিল করতে পারেন।
কিন্তু ফরিয়াদী/অভিযোগকারী খালাসের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপিল করতে পারেন না। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪১৭ ধারায় খালাসের বিরুদ্ধে আপিল সংক্রান্ত বিধান আছে।
অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল
কোন মামলায় আসামীকে দন্ড দেওয়ার পরেও বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষ যদি মনে করে যে, নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য যে দন্ড দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয় তাহলে দন্ড বৃদ্ধির জন্য আপিল করা যেতে পারে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪১৭(এ) ধারায় অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যেকোন মামলায়, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কিংবা দায়রা আদালতে প্রদত্ত কোন রায়ে অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউটর সরকারের নির্দেশে ’হাইকোর্টে’ আপিল দায়ের করতে পারেন।
আর যদি ফরিয়াদী বা অভিযোগকারী অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে চান সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আপিল আদালতে (দন্ডের বিরুদ্ধে আপিলের যে বিধান) আপিল দায়ের করবেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর কিংবা অভিযোগকারী উভয়ের আপিল দায়ের করতে হবে রায়ের ৬০ দিনের মধ্যে।
কখন আপিল করা যায় না?
কোন মামলায় আসামী যদি দোষ স্বীকার করে এবং আদালত দোষ স্বীকারের ভিত্তিতে দন্ড দেয় তাহলে সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলে না। এক্ষেত্রে দন্ডের পরিমাণ ও দন্ডের বৈধতার প্রশ্নে আপিল চলে। ৪১২ ধারায় আপিলের এই বিধানের কথা বলা আছে।
কোন তুচ্ছ মামলায় আপিল করা যায় না। দায়রা আদালত যদি কেবল ১ মাসের কারাদন্ড দিলে অথবা অন্যসব আদালত মূল শাস্তি কারাদন্ড না দিয়ে ৫০/= টাকা জরিমানা করলে এবং জরিমানা অনাদায়ে কারাদন্ড হলে সে কারাদন্ডের বিরুদ্ধে আপিল চলে না।
২৬০ ধারার অধীন সংক্ষিপ্ত বিচারের কোন মামলায় সর্বোচ্চ ২০০/= টাকা জরিমানা করলে তার বিরুদ্ধে আপিল চলবেনা।
এক কথায় আপিলের অধিকার আইন দ্বারা সৃষ্টি। শুধুমাত্র ঘটনার প্রশ্নে ও আইনের প্রশ্নে আপিল করা যায়।
আপিল নিষ্পত্তিতে আপিল আদালতের ক্ষমতা
আপিল আদালত কোন আপিল সংক্ষিপ্তভাবে বা সরাসরি খারিজ করতে পারেন। আদালত যদি মনে করেন যে, আপিলে হস্তক্ষেপ করার মতো কোন কারণ নেই তাহলে তিনি আপিল খারিজ করতে পারেন। এখানে একটি শর্ত হলো যে আপিলকারী বা তার আইনজীবীকে বক্তব্য পেশের সুযোগ ব্যতীত আপিল খারিজ করা যাবেনা।
৪২১ ধারার এই বিধান অনুযায়ী আদালত আপিল খারিজ করার পূর্বে মামলার নথি তলব করতেও পারেন কিন্তু এটা বাধ্যবাধকতা নয়।
খালাসের বিরুদ্ধে কোন আপিলের ক্ষেত্রে আপিল গ্রহণকারী আদালত খালাসের আদেশ পরিবর্তন করতে পারেন। মামলায় অধিকতর অনুসন্ধানের আদেশ দিতে পারেন, আসামীর পুনঃবিচারের আদেশ দানও করতে পারেন অথবা তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আইন অনুসারে দন্ড দিতেও পারেন।
আবার দন্ডাদেশের আপিলের ক্ষেত্রে আপিল আদালত দন্ডাদেশ পরিবর্তন করে আসামীকে খালাস/অব্যহতি দিতে পারেন, আসামীকে পুনঃবিচারের জন্য পাঠাতে পারেন কিংবা দন্ড হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারেন।
যেক্ষেত্রে বাদী বা রাষ্ট্রপক্ষ অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের জন্য আপিল করেন সেক্ষেত্রে আপিল গ্রহণকারী আদালত দন্ড বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে ৪২৩ ধারায় এটাও বলা হয়েছে যে, দন্ড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আসামীকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে।
তাছাড়া আপিল আদালত দন্ড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যা বিচারিক আদালত সুর্নিদিষ্ট অপরাধটির জন্য যে দন্ড দিতে পারতেন তার চেয়ে বেশি এমন কোন দন্ড দিতে পারবেন না ।
ফৌজদারী মামলায় আপিলের শর্তে কি জামিন পাওয়া যায়?
যখন বিচারিক আদালত কোন দন্ড দেন আসামী যদি সে দন্ডে সংক্ষুব্দ হন তাহলে তার আপিল করার বিধান আছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুযায়ী আপিলের শর্তে জামিনের বিধানের কথা উল্লেখ আছে।
এই ধারায় বলা হয়েছে, দন্ডিত ব্যক্তির আপিল সাপেক্ষে আপিল আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে দন্ড স্থগিতের আদেশ কিংবা আসামী আটক থাকলে তার নিজের মুচলেখায় জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
৪২৬(২এ) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারিক আদালত কোন ব্যক্তিকে অনধিক এক বছরের জন্য কারাদন্ড দিলে এবং উক্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান থাকলে এবং বিচারিক আদালত যদি মনে করে যে, উক্ত ব্যক্তি আপিল দায়ের করতে পারে বা করবে তাহলে আদালত দন্ডিত আসামীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে।
একই ধারার ২বি ধারার আলোচনা হাইকোর্টও চাইলে দন্ডিত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। আপিলে হাইকোর্ট যদি কোন দন্ড প্রদান করেন ঐ দন্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের জন্য বিশেষ আদেশ থাকলে এবং হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত মনে করলে আপিলকৃত দন্ড স্থগিতের এবং আটক থাকলে আসামীর জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারেন।
আপিল চলাকালীন আসামী বা বাদীর মৃত্যু হলে কি হয়?
ফৌজদারী কার্যবিধিতে আপিল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আপিল চলাকালীন যদি বাদী বা আসামীর মৃত্যু হয় তাহলে তার পরিণাম কি হবে সে নিয়েও এই কোডে বলা হয়েছে।
খালাস বা অপর্যাপ্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালীন আসামী মারা গেলে আপিলটি চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু আপিল চলাকালীন কোন পাবলিক প্রসিকিউটর বা বাদী মারা গেলেও আপিলটি বাতিল হবে না।
এবার বাকি থাকে দন্ডাদেশ। আমাদের মনে রাখতে হবে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে সবসময় আপিল করে আসামী। এক্ষেত্রেও আসামী যদি মারা যায় তাহলে আপিলটি বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে একটি শর্ত হচ্ছে জরিমানার বিরুদ্ধে কোন আপিলে যদি আসামী মারা যায়ে সেক্ষেত্রে আপিলটি বাতিল হয়ে যাবে না। এক্ষেত্রে আসামী/আপিলকারী মারা গেলে তার আইনগত প্রতিনিধি উক্ত আপিলে স্থলাভিষিক্ত হবে। তাছাড়া মৃতের সম্পত্তি থেকে অর্থদন্ড আদায়যোগ্য হবে।
উপসংহার
শুরুতেই বলেছি ফৌজদারী মামলায় আপিল আইন কর্তৃক সৃষ্ট অধিকার। ফৌজদারী মামলায় আপিল করতে হলে আইনের নানান বিধি-বিধান মেনেই করতে হয়। আইনে অবারিত সুযোগ আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের। আমাদের পরামর্শ থাকবে আপিল করলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শক্রমে করবেন।