ফৌজদারী মামলায় জামিন যেভাবে পাওয়া যাবে

জামিন

কোন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। কোন মামলায় কেউ অভিযুক্ত হলেই কেউ অপরাধী নয়। অভিযুক্ত এবং অপরাধী দুটো ভিন্ন। ফৌজদারী মামলা সংক্রান্ত সকল বিধি-বিধান ফৌজদারী কার্যবিধিতে বলা আছে।

একটি ফৌজদারী মামলায় কখন একজন অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া যাবে সে বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির বিভিন্ন ধারায় বলা আছে। আজকের আলোচনায় একটি মামলায় কোন কোন ধারায় একজন অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া যায় এবং সে সংক্রান্ত বিধান নিয়ে লিখবো।

জামিন কি?

জামিন হলো কোন মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া। একটি ফৌজদারী মামলায় জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ২য় তফসিলের পঞ্চম কলামে দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারার অপরাধ সম্পর্কে বলা আছে। কোন অপরাধ জামিনযোগ্য ও কোন অপরাধ জামিন-অযোগ্য সে অনুযায়ী সাধারণত জামিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আদালত। অথবা সহজে বুঝতে চাইলে এটুকু ধারণা রাখতে পারেন যে, সাধারণ চোখে যেসব অপরাধ গুরুতর তা জামিন-অযোগ্য আর যেসব অপরাধ ছোট বা খুব বেশি ক্ষতিকর নয় বা পুনরাবৃত্তি ঘটবে না সেসব জামিনযোগ্য।

জামিন বা Bail শব্দটি ফরাসি  ভাষার Baillier থেকে উদ্ভুত। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় সরবরাহ করা। প্রচলিত নিয়মে আদালত কোন জামিনদারের মুচলেখায় নিয়মিত মামলায় হাজিরা দেওয়ার শর্তে সাময়িক মুক্তি প্রদানকে জামিন বলা যায়।

জামিন সংক্রান্ত সাধারণ আইনী বিধান

জামিন বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭, ৪৯৮ ও ৫১৪ এই চারটি ধারায় মূল আলোচনা করা হয়েছে। ৪৯৬ ধারানুযায়ী যেকোন জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে। এক কথায় জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পাওয়ার অধিকারী। তবে এই ধারায় আরও একটি  কথা বলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি জামিনদার বা মুচলেখা দিতে  সম্মত হন তবেই তাকে আদালত জামিন দিবেন। তাছাড়া জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার।

জামিন-অযোগ্য অপরাধে যখন জামিন দেওয়া যায়

৪৯৭ ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন কখন দেওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আগের প্যারাতেই আলোচনা করা হয়েছে যে জামিনযোগ্য এবং জামিন –অযোগ্য অপরাধ কি কি এবং কোথায় এর বিস্তারিত দেওয়া আছে। এই ধারা আলোচনা করতে গেলে একটি  বিষয় জানানো উচিৎ সেটা হলো জামিন দেওয়া বা না দেওয়া কিন্তু আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা। যদিও জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া অভিযুক্তের আইনগত অধিকার।

জামিন-অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত জামিন দিবেন কিনা সেটা আদালতের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে আইনে এটাও স্পষ্ট করে বলা আছে যে জামিন-অযোগ্য অপরাধে কখন একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যেতে পারে।

বিশেষত ৪টি ক্ষেত্রে জামিন-অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও আদালত চাইলে জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। যদি কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স ১৬(ষোল) বছরের কম হয়, স্ত্রীলোক হয়, অসুস্থ বা পীড়িত হয়, অক্ষম হয় তাহলো আদালত জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। তবে জামিন-অযোগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনগত অধিকার নয়। এই ধারায় আরও একটি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় কোন অপরাধে অভিযুক্ত বলে বিশ্বাস করার কারণ থাকলে আদালত উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করবেন না। আদালতের প্রতি এরূপ নির্দেশনা আদেশসূচক।

হাইকোর্ট ও দায়রা আদালতের জামিন ও অন্তবর্তীকালীন জামিন দেওয়ার ক্ষমতা

দেশের সর্বোচ্চ আদালত হলো হাইকোর্ট এবং জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ফৌজদারী আদালত হলো দায়রা আদালত। এই দুই আদালতের জামিন দেওয়ার  আলাদা ক্ষমতা সম্পর্কে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। দেশের ফৌজদারী আদালতের গঠন ও ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের লেখাটিও পড়তে পারেন।

জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট  ও দায়রা আদালতকে অসীম ক্ষমতা আইনে দেওয়া হয়েছে। এই দুই আদালত চাইলে যেকোন সময় যেকোন ক্ষেত্রে কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দিতে পারেন। তাছাড়া আমরা যে আগাম বা অন্তবর্তীকালীন জামিনের বিষয়ে জানি সেটিও এই ধারা অনুযায়ী আদালত চর্চা করে থাকেন।

আগাম জামিন হলো কোন ব্যক্তি যদি বিশ্বাস করে থাকেন যে কোন অপরাধে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত হয়ে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন তাহলে তিনি আগাম বা অন্তবর্তীকালীন জামিনের আবেদন করতে পারেন।

হাইকোর্ট এবং দায়রা আদালত যেকোন সময় কোন ব্যক্তিকে আগাম বা অন্তবর্তীকালীন জামিন দিতে পারেন  এবং প্রয়োজনে জামানত হ্রাসের নির্দেশও দিতে পারেন। তবে ৪৯৮ ধারায় জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা।

নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত শেষ না হলে জামিনের বিধান

পাঠক এতক্ষণ উপরের প্যারায় যেমব বিষয়ে আলোচনা করেছি সেসব জামিনের সাধারণ বিধান। উপরের লেখা পড়ে নিশ্চয় ‍বুঝেছেন সাধারণত কখন জামিন দেওয়া হয়। এসব ছাড়াও বিশেষ বিশেষ ধারানুযায়ী জামিন প্রদানের মঞ্জুর করার বিধান আছে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(৫) ধারামতে একজন অভিযুক্ত জামিন পেতে পারেন। এই ধারার বিধান হলো কোন অপরাধের তদন্ত যখন ১২০(একশত বিশ দিন) এর মধ্যে সমাপ্ত না হয় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা দায়রা আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে কিছু বিধান মেনে জামিন দিতে পারেন।

মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন এবং ১০ বছরের অধিক কারাদন্ডের অপরাধ ব্যতিত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে যদি অপরাধের তদন্ত ১২০ দিনের মধ্যে সমাপ্ত না হয় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে জামিন দিতে পারেন।

আবার ভিন্ন বিধান হলো দায়রা আদালতের ক্ষেত্রে। যেকোন পরিমাণ কারাদন্ডের অপরাধের তদন্ত যদি ১২০ দিনের মধ্যে সমাপ্ত করা না যায় তাহলে সন্তুষ্টি সাপেক্ষে দায়রা আদালত জামিন দিতে পারেন।

নির্দিষ্ট সময়ে বিচার শেষ না হলে জামিনের বিধান

আইনে কোন সময়ের মধ্যে কোন কাজ করতে হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট বলা আছে। ১২০ দিনের মধ্যে যেমন তদন্ত শেষ না হলে জামিন দেওয়া যায় তেমনি নির্দিষ্ট সময়ে মামলার বিচার শেষ না হলে জামিন দেওয়া সম্পর্কে আইনের স্পষ্ট বিধান আছে।

৩৩৯(সি) ধারানুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কোন মামলা বিচারের জন্য পাওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে এবং দায়রা আদালত, অতিরিক্ত দায়রা আদালত, সহকারী দায়রা আদালত মামলা বিচারের জন্য পাওয়ার ৩৬০ দিনের মধ্যে অবশ্যই বিচার সমাপ্ত করার বিধান আছে। এই ধারায় আরও বলা হয়ে এই উল্লেখিত সময়ের মধ্যে যদি বিচার সমাপ্ত করা না যায় তাহলে অ-জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দিতে পারেন।

আপিলের শর্তে জামিনের বিধান

যখন বিচারিক আদালত কোন দন্ড দেন আসামী যদি সে দন্ডে সংক্ষুব্দ হন তাহলে তার আপিল করার বিধান আছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুযায়ী আপিলের শর্তে জামিনের বিধানের কথা উল্লেখ আছে।

এই ধারায় বলা হয়েছে, দন্ডিত ব্যক্তির আপিল সাপেক্ষে আপিল আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে দন্ড স্থগিতের আদেশ কিংবা আসামী আটক থাকলে তার নিজের মুচলেখায় জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।

৪২৬(২এ) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারিক আদালত কোন ব্যক্তিকে অনধিক এক বছরের জন্য কারাদন্ড দিলে এবং উক্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান থাকলে এবং বিচারিক আদালত যদি মনে করে যে, উক্ত ব্যক্তি আপিল দায়ের করতে পারে বা করবে তাহলে আদালত দন্ডিত আসামীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে।

একই ধারার ২বি ধারার আলোচনা হাইকোর্টও চাইলে দন্ডিত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। আপিলে হাইকোর্ট যদি কোন দন্ড প্রদান করেন ঐ দন্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের জন্য বিশেষ আদেশ থাকলে এবং হাইকোর্ট  বিভাগ উপযুক্ত মনে করলে আপিলকৃত দন্ড স্থগিতের এবং আটক থাকলে আসামীর জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারেন।

নথি তলব করে জামিনের বিধান

হাইকোর্ট বা দায়রা আদালত তাদের অধস্তন যেকোন ফৌজদারী আদালতের সিদ্ধান্ত, দন্ড বা আদেশের বৈধতা, নির্ভূলতা বা যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য নথি তলব করতে পারেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৫ ধারার বিধান অনুযায়ী উক্ত দুই আদালত নথি পরীক্ষার পর কোন শাস্তি স্থগিত এবং আসামী আটক থাকলে তাকে জামিনে বা তার নিজ মুচলেখায় মুক্তি দিতে পারেন।

সাধারণত উচ্চ আদালতের নজরে নিম্ন আদালতের কোন ভুল বা আদেশের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য আবেদন করা সাপেক্ষে আদালত যাচাই বাচাইয়ের পর সিদ্ধান্ত দেন।

জামিন নিয়ে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত

উচ্চ আদালত একটি মামলায় বলেছেন, ‘জামিন অভিব্যক্তিটির মৌলিক ধারণা হইল, যেকোন ব্যক্তিকে পুলিশ কাস্টডি হইতে প্রতিশ্রুতি দাতার হাতে অর্পণ এবং উক্ত প্রতিশ্রুতিদাতা এইরূপ ব্যক্তি যিনি আদালত যখনই প্রয়োজন মনে করেন তখনই উপযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করিবার প্রতিশ্রুতি দেন। [5 DLR (FC) 154]

আরেকটি  মামলায় জামিন নিয়ে বলা হয়েছে, আদালতের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, অপরাধী মৃত্যুদন্ডে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় অপরাধ করিয়াছে তবে উক্ত আসামীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যায় না।

যথাযথভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার এজাহার দায়ের করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানী টিম অনুসন্ধান করিবার পর এজাহারকারী এজাহারে দরখাস্তকারী অপরাধীর বিরুদ্ধে দোষারোপিত ঘটনা এজাহারে ব্যক্ত করেন। এইরূপ অবস্থায় এই  আদালতের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, দরখাস্তকারী অপরাধী মোস্তাফিজুর রহমান উপরে উল্লিখিত টাকার উপর আধিপত্ত পাইয়া বিভিন্নভাবে নিজের সহচরদের নামে উঠাইয়া অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মত বিভিন্ন প্রভৃতির অপরাধ করিয়াছেন এবং উক্ত অপরাধ যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয়। বিজ্ঞ দায়রা জজ সঠিকভাবে তাহার জামিনের আবেদন নাকচ করিয়াছেন এবং আমরা তাহার জামিন মঞ্জুরের কোন কারণ দেখি না। [41 DLR 227]

আমাদের পরামর্শ

জামিন পাওয়া বা না পাওয়া একটি আইনী প্রশ্ন। আজকের এই লেখায় ফৌজাদারী কার্যবিধি অনুযায়ী জামিন সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আমরা এটাও জানাতে চাই জামিন নিয়ে এই লেখা অবশ্যই সম্পূর্ণ না।

কোন ফৌজদারী মামলায় জামিন পাওয়া বা না পাওয়া নির্ভর করে মামলার বিষয়ের উপর। জামিন বিষয়ে আজকের লেখাটি কেবল প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে লেখা। কোন মামলায় জামিন হবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ আদালতের নিজস্ব বিবেচনার বিষয়। পাশাপাশি কোন মামলায় জামিন হবে কিনা সে বিষয়ে জানতে অবশ্যই কোন বিজ্ঞ কোন আইনজীবীর পরামর্শ নিন। ধন্যবাদ।

About the Author

Adv. Shipta Barua

Advocate Shipta Barua is a distinguished legal professional practicing at the Cox's Bazar District and Session Judge Court in Bangladesh. An alumnus of CBIU & Southern University Bangladesh, He has dedicated her career to social justice and advocacy. Beyond his legal practice, Advocate Barua contributes to the legal community as an adviser for Legal Home, a platform providing legal insights and resources. His writings cover various legal topics, reflecting her commitment to educating and empowering the public.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You may also like these