রিতা এবং সুমন দু’জন একুশ বছর সমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকা। দীর্ঘ দুই বছর ধরে তাদের প্রেমের সম্পর্ক। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, নিয়মিত মোবাইলে কথা বলা, হুয়াটসএপে চ্যাটিং তাদের প্রেমের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি রিতার আর্থিক সমস্যায় সুমন বেশবার সহযোগিতা করেছে এবং রিতাও সুমনকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে থাকে।
শেষ একবছর ধরে বিভিন্ন সময় ঘুরতে যাওয়ায় এবং নিজেদের বাড়িতে গোপনে তাদের মধ্যে যৌথ সম্মতিতে কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রিতা এবং সুমন নিয়মিত কথোপকথনে একে অপরকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তাঁরা স্বপ্ন দেখছে সংসার করার, আজীবন একসাথে ঘর করার।
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যথারীতি প্রেমের সন্দেহের কারণে সুমন রিতাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে এবং তা রিতা বেশ ভালোভাবে ঠাহর করতে পারছে। যেহেতু রিতার সাথে সুমনের বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে এবং আর্থিক লেনদেন ছিলো রিতা সুমনের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এবং প্রতারণার অভিযোগে মামলা করার কথা ভাবছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রিতা আইনি পদক্ষেপ হিসেবে কি ধরণের মামলা করতে পারে বা কি করা উচিৎ?
প্রথমেই বলে রাখা উচিৎ যে আইন খুবই সীমাবদ্ধ এবং কঠিন। কারো বিরুদ্ধে কোন গুরুতর অভিযোগ আনতে গেলে তার অবশ্যই প্রাইমা ফ্যাসি মানে প্রাথমিক প্রমাণ থাকা আবশ্যক। তাছাড়া দেশের প্রচলিত আইনে অভিযোগগুলোকে কিভাবে বর্ণণা করা হয়েছে তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
উপরের প্যারায় কাল্পনিক যে গল্পটা সাজানো হয়েছে তা নিশ্চয় অনেকের জীবনে ঘটছে এবং সিদ্ধান্তহীনতা এ জায়গায় বেশি দেখা যায়। আইনের বইয়ে একটু মন দেয়া যাক। বলে রাখি যে, আমাদের দেশে প্রেমের প্রতারণা নিয়ে নির্দিষ্ট কোন আইন এখনো পর্যন্ত নেই।
তবে হ্যাঁ ধর্ষণ এবং প্রতারণা নিয়ে দন্ডবিধি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কিছু ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। দন্ডবিধির ৫১৫ ধারায় প্রতারণার সংঙ্গা এবং ৪১৭ ও ৪২০ ধারায় বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার শাস্তি বলা আছে। প্রতারণার মামলা খুবই সামন্য আইনের দৃষ্টিতে।
প্রতারণার মামলা জামিনযোগ্য, আদালত অনুমতি দিলে মীমাংসারযোগ্য। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধর্ষণ। রিতা ও সুমনের যৌথ সম্মতির আরামদায়ক শারীরিক সম্পর্ক কি ধর্ষণ হিসেবে রিতা অভিযোগ করতে পারে? উত্তর হলো পারে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সংঙ্গা অনুরূপ “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ (ষোল) বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ১৬ (ষোল) বৎসরের কম বয়সের নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”
পাঠক একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন ব্যাখ্যায় সম্মতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। উপরের রিতা আর সুমনের গল্পে আমরা দেখি যে, তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের কারণে গোপনে একাধিকবার প্যাশেনেট সেক্স বা আরামদায়ক শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। সুতরাং তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না।
পাঠক আরেকটি প্রশ্ন আপনার মানে আসতে পারে তা হলো ব্যাখ্যায় ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতারণার কথাও উল্লেখ আছে, তাহলে বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক একধরণের প্রতারণা নয় কি? অবশ্যই হ্যাঁ। কিন্তু একেক ঘটনার আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা এবং অনেক আইনি প্রশ্নে এধরণের নানান যুক্তিকে উচ্চ আদালত নাকচ করে দিয়েছে এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত শুনিয়েছে।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলায়, যা ৫১ ডি.এল.আর এর ১২৯ পৃষ্টায় এবং আরেকটি একই ধরণের মামলা যা ১৭ বি.এল.টির ২৫ পৃষ্টায় উল্লেখ আছে “১৬ (ষোল) বছরের অধিক বয়সী কোন মেয়েকে যদি কোন পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তা ধর্ষণের আওতায় আসবে না।
কোন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তী সময়ে সে সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি লঙ্গণের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৬ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ধর্ষণ বলা যাবে। কারণ এ বয়সী মেয়ে সম্মতি দেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না।”
তাছাড়া আরো অনেক রুলিংস বা মামলার নজীর রয়েছে যেক্ষেত্রে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা যথাযথ নয় বলে আদালত মন্তব্য করেছে। সুতরাং আইনের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা এবং উচ্চ আদালতের নজীর দেখার পর এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ মামলা ঠিকঠাকমতো চলতে পারে না।
উপরিউক্ত আইনি বিষয় বিবেচনায় আনলে দেখা যায় যে রিতা সুমনের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা হিসেবে ধর্ষণের মামলা করতে পারে না কেবল প্রতারণার মামলা করতে পারে তাও শক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন একটি বিশেষ আইন। এই আইনের মামলা পরিচালনার জন্য রয়েছে আলাদা ট্রাইব্যুনাল।
তাছাড়া এই আইনের অধীন কোন বাদিনী যদি মিথ্যে মামলা করে কাউকে হয়রানী করার কথা চিন্তা করে তাহলে এই একই আইনের ১৭ ধারায় মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়েরের শাস্তি হিসেবে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ডের কথা বলা আছে। সুতরাং আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো আইনজীবী কিংবা আইন পরামর্শকের সাথে খোলামেলা আলোচনা করে নেওয়া ভালো।
পাঠক, শুরুর গল্পের রিতা এবং সুমন দু’টি ছদ্মনাম এবং তাদের প্রেমের গল্প সাজানো। আপনাদের অনেকের সাথে এই সাজানো গল্পের আংশিক কিংবা পুরোপুরি মিল থাকতে পারে। এমন নয় যে, এই লেখায় প্রদত্ত পরামর্শের উপর ভিত্তি করে আপনি আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
একেক ঘটনাকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এবং ঘটনার উপর ভিত্তি করে অভিযোগও নানান রকম হতে পারে। সুতরাং রিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কিংবা অন্যকোন হেলাফেলা আইনি অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে আনার আগে অবশ্যই আপনার আইন পরামর্শকের সাথে আলোচনা করুন, তারপর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন।