আইন পাশ করার পর একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের জায়গায় থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা। দিন যত গড়াচ্ছে এই পরীক্ষা ঠিক ততটাই পরিবর্তন করা হচ্ছে। বিগত ২০২২ ও ২০২৩ সালের বার পরীক্ষার প্রশ্ন প্যাটার্ন সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এবং প্রতিবছর নিয়মিত পরীক্ষা নিবে বলে আশা করা যায়। ২০২৪ সালের ব্যাচের পরীক্ষা শেষে এবছরই আরেকটি পরীক্ষার নোটিশ আসবে বলে আশা করা যায়। আইনের ছাত্র হিসেবে কিভাবে বার কাউন্সিল নিম্ন আদালত প্র্যাকটিস পারমিশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন সে বিষয়ে আজকের লেখায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সহজ কিছু পদ্ধতি আলোচনা করবো। আশা করি আপনাদের উপকারে আসবে।
Table of Contents
আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষার জন্য মনস্থির করা
যেকোন প্রফেশনার পরীক্ষায় বসার আগে মূল কাজ হলো মানসিক প্রস্তুতি। যেহেতু বার কাউন্সিল ইদানিং প্রতিবছর নিয়মিত অ্যাডভোকেট তালিকাভূক্তি পরীক্ষার আয়োজন করছে সেহেতু ঠিক কোন সময়টা আপনার জন্য পরীক্ষার বসার উপযোগী সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
“যার নাই কোন গতি সে করে উকালতি” এই প্রবাদের দিন ফুরিয়ে গেছে বহু আগে। আপনার ভালো লাগার ক্যারিয়ার যদি হয় আইনজীবী হওয়া সেক্ষেত্রে আটঘাট বেঁধেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তিন ধাপের প্রিলিমিনারি, রিটেন এবং ভাইবা শেষ করেই আপনাকে অ্যাডভোকেট হতে হবে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে একটি বছর নিজেকে সময় দিবেন এমন মনস্থির করুন।
সিলেবাস নির্ধারণ করা
বার কাউন্সিলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে অ্যাডভোকেট তালিকাভূক্তি পরীক্ষার সিলেবাস দেওয়া আছে। আগেভাগে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পড়বেন সে সিলেবাস নির্ধারণ করুন। সাতটি বিষয়ের উপর যেহেতু পরীক্ষা হবে সেহেতু তুলনামূলক ছোট বিষয়গুলো আগে গুরুত্ব দিয়ে মিনিমাইজ করতে হবে।
বর্তমান পরীক্ষার প্রশ্ন প্যাটার্ন বলে দেয় সাতটি বিষয়ের কোন কিছুই মোটামুটি বাদ দিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। তারপরেও শুরুতে অতি গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টারগুলো চিহ্নিত করে আয়ত্বে আনতে হবে।
ফৌজদারী কার্যবিধি-২০ নাম্বার, দেওয়ানী কার্যবিধি– ২০ নাম্বার, দন্ডবিধি-২০ নাম্বার, সাক্ষ্য আইন-১৫ নাম্বার, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন– ১০ নাম্বার, তামাদি আইন– ১০ নাম্বার, বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস– ০৫ নাম্বার এই সাতটি হলো অ্যাডভোকেট তালিকাভূক্তি প্রিলিমিনারি পরীক্ষার বিষয় ও মানবণ্টন।
অন্যদিকে লিখিত পরীক্ষায় ‘ক’ বিভাগে দেওয়ানী ও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন থেকে মোট তিনটি প্রশ্ন থাকবে, লিখতে হবে যেকোন দুইটা (পূর্ণমান-৩০)। ফৌজদারী কার্যবিধি থেকে দুইটা প্রশ্ন দেওয়া থাকবে লিখতে হবে একটা (পূর্ণমান-১৫), দন্ডবিধি থেকে দুটি প্রশ্নের মধ্যে একটি (পূর্ণমান-১৫)। সাক্ষ্য আইন থেকে দুটি লিখতে হবে একটা (পূর্ণমান-১৫), তামাদি আইন থেকে দুইটা প্রশ্নে একটা (পূর্ণমান-১৫) এবং বার কাউন্সিল অর্ডার থেকে দুটি প্রশ্নের মধ্যে একটি লিখতে হবে (পূর্ণমান-১০)।
যেভাবে পড়া শুরু করবেন
শুরুতেই নিজের মতিষ্ককে চাপ দেওয়া যাবে না। সাতটি বিষয়ের মধ্যে তুলনামূলক ছোট বিষয়গুলো আগে পড়া শুরু করতে হবে। যেমন: শুরুতে তামাদি আইন দিয়ে পড়া শুরু করা যেতে পারে। এই আইনে :ধারা আছে মাত্র ২৮টি। এরমধ্যে সবগুলো ধারা আবার সমান গুরুত্ব দিয়ে পড়তেও হয়না।
এরপর সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, সাক্ষ্য আইন এসব ধাপে ধাপে পড়া শুরু করুন। তবে এক্ষেত্রে আপনাদের নিজস্ব কোন পন্থা অবলম্বন করতে চাইলেও করতে পারেন।
এভাবে সকল বিষয় একবার শেষ হলে নিয়মিত সকল বিষয় থেকে কয়েকটি কয়েকটি চ্যাপ্টার রিভাইজ করতে পারেন। তাতে করে নিয়মিত সকল বিষয় সারসংক্ষেপ একবার করে হলেও যদি চোখ বুলাতে পারেন তবে যা পড়েছেন নিয়মিত চর্চার জন্য তা মনে থাকবে বেশি।
নিজের মতো করে নোট নিয়েও পড়তে পারেন। মূল বই কিংবা কোন ভালো লেখকের গাইড বই পড়তে গিয়ে আপনি নিজের মতো করে যাতে সহজেই বুঝতে পারেন সেজন্য বইয়ে কিংবা নোট খাতায় সংক্ষেপে নোট রাখলে পরীক্ষার আগে সেগুলো বেশ কাজে দেয়।
কঠিন বিষয়গুলোর ধারা মনে রাখার আরেকটি দারুণ উপায় হলো স্টিকি নোটস। স্টেশনারির দোকানে গিয়ে বললে আপনাকে স্টিকি নোটস দিবে। যেসব ধারা আপনার মনে থাকে না কিন্তু মনে রাখা জরুরী বা বারবার ভুলে যাচ্ছেন সেসব স্টিকি নোটসে লিখে পড়ার টেবিলের সামনে বা বাথরুমে কিংবা বিছানার সামনের দেওয়ালে পরিকল্পিতভাবে ঝুলিয়ে রাখুন।
নিজের অজান্তেই চোখের সামনে দেখতে দেখতে একসময় দেখবেন কঠিন বিষয়গুলোও মনে থাকছে।
এইতো গেলো পড়া শুরু করার কিছু পরামর্শ। এবার এটা বলাও জরুরী যে উপরে যেভাবে পড়া শুরু করার কথা বলেছি ঠিক সেভাবেই শুরু করতে হবে এমন নয়। আপনার নিজস্ব কোন নিয়ম থাকলে আপনি সেভাবে পড়া শুরু করতে পারেন।
বিগত বছরের যাবতীয় প্রশ্নের সমাধান করা
সকল বিষয়ে আপনার ভালো দখল হলে এবার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বিগত যতসব বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট তালিকাভূক্তি ও বিজেএস(সহকারী জজ নিয়োগ) পরীক্ষা হয়েছে সকল এম.সি.কিউ প্রশ্নের সমাধান করা এবং লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে লিখিত প্রশ্নগুলোর সমাধান করা।
বলে রাখা ভালো যে, বিগত বছরের যেসকল প্রশ্ন হয়েছে তার সব এম.সি.কিউ এবং লিখিত যদি আপনি সময় নিয়ে সমাধান করেন আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি বাড়বে। পাশাপাশি ৬০-৭০ শতাংশ প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কমন পাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে যা পরীক্ষার হলে আপনার লাইফলাইন হিসেবে কাজে দিবে।
বাজারে বিভিন্ন প্রশ্নব্যংক পাওয়া যায় এবং অনলাইনেও ও.এম.আর শিট পাওয়া যায়। নিজে নিজে ঘরে বসে নিয়মিত ঘড়ি ধরে ১০০ মার্কের এম.সি.কিউ পরীক্ষা দিতে থাকুন। দেখবেন অনেক কঠিন বিষয়ও সহজে বুঝতে পারছেন।
কোন ভালো কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হতে পারেন
সাতটি আইনের উপর নিজে নিজে পড়ে ভালো বুঝতে গেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের দরকার। সেক্ষেত্রে আপনার জন্য উপযুক্ত হতে পারে ভালো কোন কোচিং সেন্টার। অনেক কোচিং সেন্টারে সাতটি বিষয়ের উপর শিট দেওয়া হয় যা শুরুতে সাতটি বিষয় পড়ে সারসংক্ষেপ বুঝার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে।
তবে অনলাইনে কোচিং করাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরুৎসাহিত করি। তবে কোন অনলাইন কোচিং সেন্টার থেকে শিট নিয়ে সেসবের সহযোগিতা নিতে পারেন।
তবে কোনভাবেই শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারের শিটের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত হবেনা। শিটের পাশাপাশি মূল বই পড়েও নিয়মিত নোট করে লেখাপড়া চালিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত লেখার চর্চা করা
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, পড়ার পাশাপাশি কোন বিষয়ে লেখার চর্চা করলে তা সহজেই মুখস্ত হয়। সুতরাং নিয়মিত একটি নোট খাতা করে পড়ার পাশাপাশি লিখতে হবে। তাছাড়া এই লেখাগুলো পরীক্ষার আগে বেশ কাজে দিতে পারে এবং লিখিত পরীক্ষায় একটানা চারঘন্টা লেখার ক্ষেত্রে আর কোন ঝামেলা হবে না।
যারা নিয়মিত লিখেন না তারা টানা চারঘন্টা পরীক্ষার হলে লিখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন এবং রীতিমত খারাপ হয় লেখা।
পাশাপাশি বিভিন্ন গাইড বই ফলো করে সমস্যামূলক প্রশ্নগুলো সমাধান করতে হবে। বিগত বছরের প্রশ্ন দেখলে আমরা বুঝতে পারি সমস্যামূলক প্রশ্নের উপর বার কাউন্সিল বেশি জোর দিচ্ছে।
জীবন অভ্যাসে পরিবর্তন করা
গেলো কয়েক বছরের বার কাউন্সিলের পরীক্ষার প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করলে বুঝতে পারবেন আইন বুঝে পড়ার পাশাপাশি মুখস্তও করতে হবে। শুধুমাত্র মুখস্ত করলেও হবে না, বুঝে মুখস্ত করতে হবে।
মুখস্ত ও বুঝার জন্য আপনার প্রয়োজন সুন্দর একটি জীবন রুটিন। যেমন ভোরে উঠে নামাজ-কালাম বা নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা করে মুখ হাত ধুয়ে পড়তে বসতে পারেন। ভোর থেকে চারঘন্টা পড়তে পারলে আপনার জন্য তা হবে অনন্য সম্পদ। ভোর বেলায় নিরব-নিস্তব্দ ও বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক থাকায় পড়া মনে থাকে বেশি।
আবার মাঝখানে সারাদিন কাজ থাকলে তা সেরে সন্ধ্যায় পড়তে বসতে পারেন। সন্ধ্যায়ও চারঘন্টা পড়া যেতে পারে। রাত ১১টার মধ্যে বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া উত্তম কারণ ভোরবেলা উঠতে হলে আপনার পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটি শেষ পরামর্শ আপনার সাথে শেয়ার করতে চাই। আজকাল সকলেই ফেসবুক এবং ইউটিউব তুলনামূলক বেশি ব্যবহার করেন। আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন সময়ে আমাদের প্রধান শত্রু হিসেবে কাজ করে ফেসবুক এবং ইউটিউব। সুতরাং যদি সম্ভব হয় যে কয়েকমাস আপনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন সে কয়েকমাস মোবাইল থেকে ফেসবুকের এপস ডিলেট করে দেওয়া। যদি সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে মেসেন্জার চালু রেখে একাউন্ট সাময়িকভাবে ডিএক্টিভ করেও রাখতে পারেন।
দৈনিক আটঘন্টা লেখাপড়া করলে আমি নিশ্চিত আপনার পাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। পড়া মুখস্ত রাখা এবং বুঝার জন্য আপনার জীবন অভ্যাস মেনে চলা অত্যান্ত জরুরী।
সারাজীবনের জন্য এটাই প্রফেশনাল শেষ পরীক্ষা। নিজেকে একটি বছর নিরবিচ্ছিন্ন সময় দিন। সর্বশেষ মনে রাখতে হবে পাশ করলেও আপনার সফলতা এবং ফেইল করলে আপনরাই ব্যর্থতা। আপনি পারবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।