ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে চান?

ই-কমার্স

ই-কমার্স বা অনলাইন বিজনেস দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশ এবং দেশের বাইরের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দৈনিক কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছে দেশে।

সম্প্রতি ই-কমার্সের এমন জনপ্রিয়তার কারণে সরকারের বণিজ্য মন্ত্রনালয় নতুন ডিচিটাল ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত সকল প্রকার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে এই নীতিমালা মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। সুতরাং আপনি যদি ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে মনস্তির করেন আজকের লেখাটি আপনার জন্য।

ই-কমার্স কি?

ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়কে এককথায় ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা বলা হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী ই-কমার্স বলতে বলা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম বা ইন্টারনেটে কমার্স সাইট বা পোর্টাল যেখানে একাধিক পণ্য বা সেবার তালিকা থাকে এবং তা লেনদেনের মাধ্যমে বিক্রি হয়।

এমনকি ফেসবুক সম্প্রতি ই-কমার্স প্লাটফর্ম চালু করতে দেখা গেছে এবং আপনার অনেকেই ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে সরাসরি অনেক পণ্য বিক্রি করছেন।

ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে ফেসবুক শপিংকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছের ই-কমার্স বলতে আসলে অনলাইন শপ বা দোকানকে বুঝানো হয়েছে।

ই-কমার্স ব্যবসা শুরুর নিয়ম

অনলাইনে যদি কোন নির্দিষ্ট পণ্য বা হরেক রকমের পণ্য বিক্রি করতে চান তাহলে আপনার বেশ কিছু আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে তারপর ব্যবসা শুরু করতে হবে। আপনার একটি অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম মানে একটি ভার্চুয়াল দোকান বা প্রতিষ্ঠান।

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সকল ডিজিটাল কমার্স পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। বলতে পারেন এটা একদম অত্যাবশীয়ক কাজ।

এরপরে প্রজোয্য ক্ষেত্রে ভ্যাট নিবন্ধন করতে হবে যদি আপনার ডিজিটাল কমার্স সরাসরি কোন পণ্য আমদানি করেন। পাশাপাশি ডিজিটাল কমার্সের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের নামে টিন (TIN) সার্টিফিকেট করতে হবে।

যদি আপনার ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানকে একক কিংবা যৌথ কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন করে পরিচালনা করেন সেক্ষেত্রে ইউনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নাম্বার (UBID) বা পারসোনাল রিটেইল একাউন্ট (PRA) নাম্বার এর অন্তত একটি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আপনার ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস বা সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ তা প্রদর্শন করতে হবে।

এই নীতিমালায় বলা হয়েছে বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠান যদি বাংলাদেশে ই-কমার্স পরিচালনা করতে চান সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য এদেশে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে।

ঔষধ ও বিস্ফোরক দ্রব্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স

তবে এই নীতিমালার আরেক উপদফায় ঔষধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত একটি দফায় বলা হয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণের মাধ্যমে তা পরিচালনা করা যাবে।

পাশাপাশি দাহ্য পদার্থ যেমন: গ্যাস সিলিন্ডার, আতশবাজিসহ নানান পদার্থ বিক্রয় করতে চাইলে বিষ্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে।

সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে যদি আপনি ঔষধ কিংবা দাহ্য পদার্থ বিক্রি করতে চান সেক্ষেত্রে সংশিষ্ট অধিদপ্তরের আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে।

ই-কমার্সে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির নিয়মাবলি

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ অনুযায়ী পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবার সকল বিস্তারিত বিবরণ ও শর্তাবলি যেমন – পণ্যের মূল্য ফেরতের শর্তাবলি, পরিবর্তন, পণ্য সরবরাহের সময়সীমা সুষ্পষ্টভাবে বাংলায় উল্লেখ করতে হবে।

তাছাড়া মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়যোগ্য পণ্য বা সেবার যথাযথ বিবরণ, পণ্যের পরিমাপ, উপাদান, রং, আকৃতি, গুণগতমান, মূল্য এবং ডেলিভারিসহ অন্যান্য কোন চার্জ যদি থাকে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে বলা আছে।

এক কথায় ক্রেতা পণ্য সম্পর্কে যাতে সম্পূর্ণ ধারণা পায় এবং বুঝে-শুনে পণ্য কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ধরণের অফার, ডিসকাউন্ট, ফ্রি ডেলিভারি বা অন্যকোন সুবিধা পণ্যের সাথে থাকলে তা পরিষ্কারভঅবে পণ্যের বর্ণনায় দিতে হবে।

আপনার ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে বিক্রির জন্য প্রদর্শিত পণ্য আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে অথবা মাল্টি ভেন্ডর মার্কেটপ্লেসের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।

কি পরিমাণ পণ্য স্টকে আছে তা পণ্যের সাথে উল্লেখ এবং প্রতিটি পণ্য বিক্রয় শেষে উক্ত পণ্যের স্টক হালগাদের কথা বলা আছে।

যদি কোন পণ্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠান বা চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছে স্টক না থাকে তাহলে ‘স্টকে নেই’ বা `Out of Stock’ কথাটি স্পষ্টভাবে পণ্যের পাশে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। আউট অব স্টক পণ্যের জন্য কোন পেমেন্ট গ্রহণে রয়েছে বাধা-নিষেধ।

পণ্যের অগ্রিম মূল্য নেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয়

ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসায় পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় ডেবিট কার্ড বা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং এর কারেন্সি। যাকে আমরা ভার্চুয়াল কারেন্সিও বলতে পারি।

অনলাইন ব্যাবসা নীতিমালা অনুযায়ী অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে যদি অগ্রিম মূল্য গ্রহণ করে সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারেন তাহলে ১০ দিনের মধ্যে আপনাকে উক্ত মূল্য ফেরতের কথা বলা হয়েছে।

তাছাড়া মূল্য ফেরতে এই লেনদেনে যদি কোন প্রকার চার্জ থাকে তাহলে সেটা ই-কমার্স প্রতিষ্টানকে বহন করার কথা বলা হয়েছে। মূল্য ফেরতের পর গ্রাহককে অবশ্যই এসএমএস অথবা মোবাইল করে মূল্য ফেরতের বিষয়ে অবহিত করার কথাও এই নীতিমালায় বলা হয়েছে।

যদি কোন পণ্য বিক্রয়ের সাথে ক্যাশব্যাক অফার থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে তা ৭২ ঘন্টার মধ্যে দিতে হবে।

অনলাইন ব্যবসায় পণ্য ডেলিভারির সময়সীমা ও নিয়ম

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ মতে বিক্রয়ের জন্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পণ্যসামগ্রী ডেলিভারীম্যান বা ডেলিভারী সংস্থার নিকট হস্তান্তর করা এবং ক্রেতাকে এই বিষয়ক প্রক্রিয়া মোবাইল ফোন, ই-মেইল বা এসএমএস এর মাধ্যমে জানাতে বলা আছে।

অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে এখানে আরেকটি দফার কথা উল্লেখ আছে যে, ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান কররে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ ০৫ (পাঁচদিন) এবং ভিন্ন ভিন্ন শহর বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারী দিতে বলা হয়েছে।

কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় ও পচনশীল দ্রব্যের ক্ষেত্রে ডেলিভারীর সময় আরও সংক্ষিপ্ত হবে এবং ক্রেতাকে তা ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময় সুস্পষ্টভাবে অবহিত করতে হবে।

ডেলিভারীর ক্ষেত্রে একটি ক্রয়াদেশ (Purchase Order) এ আলাদা আলাদা ডেলিভারী চার্জ আরোপ করা যাবে না। তবে আলাদা পণ্যের ডেলিভারী স্থান ভিন্ন হলে আলাদা চার্জ করা যাবে।

পণ্য ডেলিভারীর সময় মুদ্রিত বিল পরিশোধের কথাও বলা হয়েছে এই নীতিমালায় যাতে প্রদেয় ভ্যাট ও আয়কর উল্লেখ থাকবে।

ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা পরিচালনায় যা নিষিদ্ধ

একই নীতিমালায় বলা হয়েছে ই-কমার্স ব্যবসার মাধ্যমে মাল্টি লেভেল মার্কেটি (এমএলএম) বা নেটওয়ার্ক ব্যবসা পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া আপনার অনলাইন ব্যবসায় নেশা সামগ্রী, বিষ্ফোরক দ্রব্য বা দেশে প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ কোন দ্রব্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়েও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

জুয়া বা Online betting বা Online Gambling এর আয়োজন বা অংশগ্রহণ এই নীতিমালা দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া কোন ধরণের লটারি বা র‌্যাফল-ড্র আয়োজন করার উপর বিধিনিষেধ আছে। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে কোন ডিজিটাল প্লাটফর্ম চাইলে লাটারির আয়োজন করতে পারে।

 সম্প্রতি কিছু ডিজিটাল কমার্স প্লাটফর্মে দেখা গেছে গিফ্ট কার্ড বা ডিজিটাল ওয়ালেট অফার দিয়ে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্টান থেকে শপিং করার ব্যবস্থা করেছে।

এই নীতিমালায় এসমস্ত ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফ্ট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোন মাধ্যম যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে তার ব্যবহার বা ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ই-কমার্সে গ্রাহক সেবা ও বিধিমালা

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ রয়েছে যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রদান। ই-কমার্স নীতিমালা অনুযায়ী ই-কমার্সে পণ্য ও সেবার বিষয়ে ভোক্তা ও গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তাছাড়া পাশাপাশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। তিনি অভিযোগ গ্রহণসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় সাধন করতে পারে।

কোন গ্রাহকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সে বিষয়ে বিস্তারিত ই-মেইল, এসএমএস অথবা মোবাইল ফোনে জানাতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয়ে বলা হয়েছে যে, ই-কমার্সে পণ্যের বা সেবার বিষয়ে ক্রেতা বা অন্য কারও রেটিং বা মতামত জানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে ক্রেতারা পণ্যের ব্যাপারে অন্য ক্রেতাদের মতামত বা রিভিউ দেখে ক্রয়ের সিদ্বান্ত নিতে পারে।

পরামর্শ

উপরের সকল আলোচনা জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসির আলোকে লেখা হয়েছে। খুব সংক্ষেপে চেষ্টা করছি ই-কমার্স সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে। এরমধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান শুরু করার আগে অবশ্যই কোন ভালো পরামর্শকের পরামর্শ জরুরী।

সুতরাং আমি মনে করি আইন মেনে সঠিকভাবে ই-কমার্স পরিচালনা করতে আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন আইন পরামর্শকের কোন বিকল্প নেই। খুঁটিনাটি অনেক বিষয়েই বিভিন্ন সরকারি দপ্তর আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আটকে দিতে পারে যা ব্যবসায়িক ক্ষতি।

আইন জানুন, আইন মানুন। লিগ্যাল হোমের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ্। বিস্তারিত পরামর্শের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ধন্যবাদ।

About the Author

Adv. Shipta Barua

Advocate Shipta Barua is a distinguished legal professional practicing at the Cox's Bazar District and Session Judge Court in Bangladesh. An alumnus of CBIU & Southern University Bangladesh, He has dedicated her career to social justice and advocacy. Beyond his legal practice, Advocate Barua contributes to the legal community as an adviser for Legal Home, a platform providing legal insights and resources. His writings cover various legal topics, reflecting her commitment to educating and empowering the public.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You may also like these

No Related Post