ফৌজদারী আদালতের গঠন ও বিচারিক ক্ষমতা

ফৌজদারী আদালত

ফৌজদারী আদালত বলতে যে আদালতে মানবসৃষ্ট অপরাধের বিচার হয় তাকে বুঝায়। আমাদের ফৌজদারী আইনের গঠনপ্রণালী অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধকে অনেকভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং অপরাধের ধরণ অনুযায়ী একেক অপরাধের বিচার একেক আদালতে হয়ে থাকে। আজকে আলোচনা করবো ফৌজদারী আদালতের গঠন ও বিচারিক ক্ষমতা সম্পর্কে।

ফৌজদারী আদালতের প্রাক ইতিহাস

ফৌজদারী আইনটি মূলত বৃটিশদের তৈরি একটি আইন। সে সময় ১৯৯৮ সালে আইনটি জারী হয়। সর্বশেষ ২০০৭, ২০১১ এবং ২০১২ সালে এই আইনটিতে পরিবর্তন আনা হয়।

ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ফৌজদারী কার্যবিধির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দন্ডবিধিসেহ যেসমস্ত বিশেষ আইনে অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তির কথা উল্লেখ আছে সেসব অপরাধের অধিকাংশের বিচার হয় এই আইন দ্বারা।

ফৌজদারী আদালত কত প্রকার ও কি

ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় ভাগে আদালতের গঠন ও ক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। এই কার্যবিধির ৬ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারী আদালত প্রধানত দুই প্রকার।

  • দায়রা আদালত 
  • ম্যাজিস্ট্রেট আদালত

ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।

  • জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
  • নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

এই দুই শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মধ্যে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে।

  • চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
  • প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট
  • দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট
  • তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট

লক্ষ্য করুন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দকে চারভাগে ভাগ করা হলেও মহানগর এলাকায় এসব ম্যাজিস্ট্রেটদের নাম ভিন্ন হবে। মহানগর এলাকায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পরিচিত হবে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। আবার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট মহানগর এলাকায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচিত হবে।

তাছাড়া ৬ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দদের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বুঝাবে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৯(৩এ) ধারা অনুযায়ী দায়রা আদালতে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।

  • দায়রা জজ
  • অতিরিক্ত দায়রা জজ
  • যুগ্ন দায়রা জজ

ফৌজদারী আদালতের অধীনস্থতা                           

ফৌজদারী আদালতের গঠনের সাথে সাথে কোন আদালত কার অধীনস্থ সে বিষয়ে এই কার্যবিধিতে আলোচনা করা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির বিভিন্ন ধারাতে এসব আলোচনা করা হয়েছে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৭ অনুযায়ী সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্ত থাকবেন। সকল প্রকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্ত থাকবেন। সকল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্ত থাকবেন। সকল প্রকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/মেট্রোপলিটন ও চীফ জুডিসিয়াল/মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণ- দায়রা/ মেট্রোপলিটন দায়রা জজের অধীনস্ত থাকবেন।

আবার ১৭(এ) ধারা অনুযায়ী যুগ্ন দায়রা জজবৃন্দ যে দায়রা জজের আদালতে এখতিয়ার প্রয়োগ করেন তারা ঐদায়রা জজের অধনস্ত হবেন।

ফৌজদারী আদালতসমূহের বিচারিক ও দন্ডদানের ক্ষমতা

পাঠক এই অধ্যায়ের শুরুতেই একটি বিষয় আপনাবে বুঝতে হবে। এই অধ্যায় অনুযায়ী বিচার করা ও দন্ড দান আলাদা আলাদা ক্ষমতা।  মূলত দন্ডবিধি ও অন্যান অপরাধমূহ কোন পদ্ধতিতে বিচার করবেন সে বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধিতে আলোচনা করা হয়েছে। ধারা ২৮ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ, দায়রা আদালত ও ফৌজদারী কার্যবিধির তফসিল-২ এর কলাম-৮ অনুযায়ী অন্যকোন আদালত যেকোন অপরাধের বিচার করবেন।

শুরুতেই ফৌজদারী কার্যবিধির ৩২ ধারার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করি। এই ধারায় বলা হয়েছে ১ম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেটস সর্বোচ্চ ৫ বছর ও ১০,০০০/= টাকা দন্ড দিতে পারেন। অন্যদিকে ২য় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ৩ বছর ও ৫,০০০/= টাকা  ও ৩য় শ্রেণীর ম্যাজেস্ট্রট ২ বছর ও ২,০০০/= টাকা অর্থদন্ড দিতে পারেন।

আবার উপরে উল্লিখিত জরিমানা অনাদায়ে ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দ অপরাধটির জন্য নির্দিষ্ট অর্থ্যাৎ সর্বোচ্চ কারাদন্ডের এক চতুর্থাংশের বেশি হবে না।

ধারা ৩১ এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, হাইকোর্ট আইনে অনুমোদিত যেকোন দন্ড দিতে পারেন। পাশাপাশি দায়রা জজ ও অতি: দায়রা জজ আইনে অনুমোদিত যেকোন দন্ড দিতে পারেন, তবে মৃত্যুদন্ড দিলে তা হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর করতে হয়। এবং যুগ্ন দায়রা জজ সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড দিতে পারেন।

বিশেষ বিচারিক এখতিয়ার

ফৌ: কা: ২৯বি ধারায় কিশোরদের ক্ষেত্রে বিচারের এখতিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ১৫ বছরের কোন কিশোর মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড ব্যতীত অন্যকোন অপরাধ করলে তার বিচার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সি.জে.এম) বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সি.এম.এম) বা অন্যকোন আইন দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন বিচারক করতে পারবেন।

আবার ২৯সি ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটগণের বিশেষ বিচারিক ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই ধারায় সরকার হাইকোর্ট বিভাগের সাথে পরামর্শক্রমে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সি.জে.এম)/ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সি.এম.এম)/ অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (এ.সি.জে.এম) কে মৃত্যুদন্ড ছাড়া অন্যান্য সাজার অপরাধের বিচার করবার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।

একই ধারায় আলোচনা করা হয়েছে, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এম.এম) বা ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন বা ১০ বছরের অধিক কারাদন্ড ব্যতিত অন্যান্য সাজার অপরাধের বিচার করবার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।

ধারা ৩৩এ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৯সি ধারায় বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দ উচ্চতর সাজার বিচার করার এখতিয়ার রাখলেও সর্বোচ্চ ৭(সাত) বছরের কারাদন্ড দিতে পারেন।

দন্ড কার্যকরের বিধান

একটি মামলায় যখন একাধিক ধারার অপরাধের বিচার করা হয় এবং অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয় উক্ত অপরাধের শাস্তি কারাদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হলে আদালত যদি উক্ত কারাদন্ডসমূহ একত্রে চলার নির্দেশ দেন তবে সেভাবে চলবে, যদি একত্রে চলার নির্দেশ না দেন তবে শাস্তি একটার পর অন্যটি চলবে। তবে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫ ধারায় এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরপর চলা শাস্তির ক্ষেত্রে ১৪ বছরের বেশি হবে না এবং মামলাটি যদি কোন ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করেন তবে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণ এখতিয়ারে যে শাস্তি দিতে পারেন তার দ্বিগুণের বেশী হবে না।

আরও ভালোভাবে বুঝার জন্য নিম্নে একটি উদাহরণ দিলাম।

আবুল আওয়ালের নামে একটি মামলা হলো। এই মামলায় আঘাত, চুরি ও অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে বিচার শুরু হলো এবং এই তিন অভিযোগ প্রমাণে ধারাভিত্তিক আলাদা আলাদা সাজা হলো। তাহলে এখানে দেখা যায় যে, একটি মামলায় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারার অপরাধ আছে। এই তিন অপরাধের শাস্তি হিসেবে যদি বিচারক উল্লেখপূর্বক ৬মাস, ২ মাস, ১ মাস শাস্তি দেন। এবং উল্লেখ করে দেন যে একত্রে শাস্তি চলবে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শাস্তি যেহেতু ৬ মাস, এই ৬ মাসের পরেই সাজা শেষ হবে। আর যদি আলাদা একটির পর অন্যটি চলবে উল্লেখ করে তাহলে আলাদা চলবে।

বিচার চলাকালীন কারাবাস কি শাস্তি থেকে বাদ যাবে?

হ্যাঁ। ফৌ: কা: ৩৫এ ধারা অনুযায়ী শুধুমাত্র মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ছাড়া অন্যকোন দন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তি বিচার চলাকালীন সময়ে কারাবাস ভোগ করলে সেক্ষেত্রে মূল দন্ড থেকে হাজতে থাকা কারাবাসের সময় বাদ যাবে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যদি প্রদত্ত দন্ডের চেয়ে বিচার চলাকালীন কারাবাস বেশি হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ মুক্তি পাবেন এবং শাস্তির পাশাপাশি অন্যকোন অর্থদন্ড করা হলে তাও মওকুফ হয়ে যাবে।

শেষকথা

এতক্ষণ উপরের লেখায় চেষ্টা করেছি ফৌজদারী অপরাধে ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজবৃন্দের বিচারিক ক্ষমতা সম্পর্কে। একটি বিষয় সবশেষে আলোচনা করা দরকার। ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১এ ধারায় হাইকোর্টকে সহজাত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে এই বিধিতে যে বিধানই উল্লেখ থাকুক না কেন আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের অপব্যবহার রোধকল্পে ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে হাইকোর্ট যেকোন আদেশ দিতে পারেন।

৩টি বিষয়ে মূলত হাইকোর্ট তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে।

১. এ বিধির অধীন প্রদত্ত কোন আদেশ কার্যকর করার জন্য। ২. কোন আদালতের  কার্যক্রম রোধ করার জন্য। ৩. অন্যকোনভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য।

সুতরাং আজকের এই লেখায় আশা করি ফৌজদারী আদালতের বিচারি ক্ষমতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হলো। পরবর্তী কোন আলোচনায় আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।.

About the Author

Adv. Shipta Barua

Advocate Shipta Barua is a distinguished legal professional practicing at the Cox's Bazar District and Session Judge Court in Bangladesh. An alumnus of CBIU & Southern University Bangladesh, He has dedicated her career to social justice and advocacy. Beyond his legal practice, Advocate Barua contributes to the legal community as an adviser for Legal Home, a platform providing legal insights and resources. His writings cover various legal topics, reflecting her commitment to educating and empowering the public.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

You may also like these