সাক্ষ্য আইন দেওয়ানী কিংবা ফৌজদারী মামলা প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি মামলার প্রমাণ নির্ভর করে সাক্ষ্যের গুণাগুণের উপর। দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় মামলায় সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণের পর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
Table of Contents
সাক্ষ্য আইন কি?
সাক্ষ্য আইন হলো এমন একটি আইন যা সংঘটিত অপরাধসমূহের দাবী আদালতে প্রমাণের সঠিক নিয়ম বা পদ্ধতি। যে আইন আদালতে মামলার বিচার পরিচালনায় সাক্ষ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধান ও নিয়ম নিয়ন্ত্রণ করে তাকে এককথায় সাক্ষ্য আইন বলা হয়।
মূলত এই আইনের মাধ্যমে আদালতে মামলার বিচারে বা শুনানীতে বাদী-বিবাদীর দাবী প্রমাণ ও খন্ডন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদালতে দাবী কিভাবে প্রমাণ করতে হবে, প্রমাণের বিষয়সমূহ উপস্থাপন, ও আদালত কিভাবে তা যাচাই করবে এবং এগুলোর প্রাসঙ্গিকতা, গ্রহণযোগ্যতাসহ নানান বিধি বিধান এই আইনে আলোচনা করা হয়েছে।
সাক্ষ্য আইনের পরিধি
একটি মামলায় আদালত সাধারণত দুটি বিষয়ে কাজ করেন, প্রথমত হচ্ছে নির্দিষ্ট ঘটনার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা নির্ধারণ দ্বিতীয়ত, ঐ নির্ধারিত ঘটনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত আইনের প্রয়োগ এবং ঐসকল ঘটনা প্রভাবিত বিষয়ে মূল আইন প্রয়োগ করে পক্ষদের অধিকার বা দায়বদ্ধতা ঘোষণা করা।
কোন ঘটনা বিচারিকভাবে গ্রহণ এবং তার ভিত্তিতে কোন কাজ করার পূর্বে ঘটনাটি প্রমাণ বা অন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। প্রমাণ করা অবশ্যক কি আবশ্যক নয় তা একটি আইনগত প্রশ্ন। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম সাপেক্ষে সব পদ্ধতিতেই এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, ঘটনা প্রমাণিত হতে হবে।
মামলায় সাক্ষ্য হচ্ছে প্রমাণের মূল ভিত্তি। সাক্ষ্য যদি গৃহীত ও বিশ্বাসযোগ্য হয় তবে বিষযটির প্রমাণ হয়। যে সাক্ষ্য গৃহীত হবে তার গুণাগুণ এবং যে পদ্ধতিতে তা প্রদান করা হবে তা প্রতিটি দেশের প্রচলিত নিয়মে নির্ধারিত হবে।
কোন পদ্ধতিতে বিচার্য বিষয় আদালতে উপস্থাপিত হবে তা হচ্ছে সাক্ষ্য আইনের বিষয়। সাক্ষ্য আইন পদ্ধতিগত আইনের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। এই আইনের অনুপস্থিতি বিচার অনির্ধারিতভাবে মামলা দীর্ঘায়িত করে এবং তা জনগণের ভোগান্তি।
সাক্ষ্য আইন কেনো গুরুত্বপূর্ণ
পদ্ধতিগত আইন হিসেবে সাক্ষ্য আইন আমাদের দেশে প্রচলিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী কার্যবিধির সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। এই দুই কার্যবিধিতে যেখানে মামলা পরিচালনার পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, সাক্ষ্য আইন সেখানে মামলা প্রমাণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে।
আমাদের প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব আরো অনেক বেশি হওয়ার কারণ হলো আমাদের Adversarial court system বা আদালত ও বিচারক অন্ধ। তিনি নিজে কোন অনুসন্ধানমূলক তৎপরতা চালান না বরং বাদী/বিবাদী বা ফরিয়াদি/আসামীর আইনজীবীদের কৌশলী বক্তব্য বা দলিলপত্র হাতড়ে কাগজে কলমে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন যেটা অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধের হাতি দর্শনের মত হয়।
সম্ভবত এ কারণেই জেরেমি বেনথাম বলেছেন, উকিলের ফি প্রজনন করার জন্য সাক্ষ্য আইনের আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত হয়েছে। অন্যদিকে Inquisitorial বিচার ব্যবস্থায় বিচারক নিজে থেকে বিচার পূর্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন।
মামলার বিচারে সাক্ষ্য আইন
সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর বিধান দেওয়ানী ও ফৌজদারী প্রকৃতির মামলার বিচারের জন্য বিধিবদ্ধ হয়েছে। শুধুমাত্র দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিচারের জন্য সুস্পষ্ট কিছু বিধান আছে যেগুলো একই সাথে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিচারে প্রযোজ্য।
সাক্ষ্য আইনের ইতিহাস
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের পূর্বে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে জন্মলাভ করা পাকিস্থানের একটি প্রদেশ (পূর্ব পাকিস্থান) ছিল। তার আগে প্রায় ২০০ বছর ভারত ছিল ব্রিট্রিশ উপনিবেশ।
মোগল আমলের আইন ব্যবস্থার বদলে ধীরে ধীরে ভারতে ব্রিটিশ আইন চালু হতে থাকার ফল হিসেবে মোগল আমলের প্রচলিত সাক্ষ্য আইন বাতিল হয়। ভারতের কোলকাতা, বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) ও মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) প্রেসিডেন্সির জন্য ইংলিশ সাক্ষ্য আইনের নিয়ম ব্যবহার শুরু হলেও এসব এলাকার বাইরে তথা মফস্বল এলাকার জন্য এ সময় কোন আইন পাস করা হয়নি।
ফলে ব্রিটিশ ভারতে ঐসময় ভিন্ন ভিন্ন এলাকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন চালু ছিলো। পরে সমগ্র অঞ্চলের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের লক্ষ্যে ব্রিট্রিশ সরকার কাজ শুরু করে। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন পাস হতে থাকে। ১৮৬১ সালে গঠিত তৃতীয় আইন কমিশনের ১৮৬৮ সালের আগষ্টে দাখিলকৃত ৫ম রিপোর্ট ছিল সাক্ষ্য আইনের বিষয়ে।
১৮৬৮ সালে Sir Henry Maine সাক্ষ্য আইনের একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করেছিলেন। সেটি লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে উপস্থাপন করা হলে তা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। অবশ্য তা এই অঞ্চলের জন্য উপযোগী নয় বলে বাতিল হয়।
এরপর Sir Fitzjames Stephen নুতন একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করেন। ১৮৭১ সালে তা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। সমগ্র ব্রিট্রিশ ভারতের জন্য ১৫ মার্চ ১৮৭২ সালে The Indian Evidence Act, 1872 নামে আইন হিসেবে পাস এবং ১ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ থেকে কার্যকর হয়। আইনটি ১৫ আগষ্ট ১৯৪৭ থেকে পাকিস্থান ও পরে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশে কার্যকর আছে।
আইনটি বাংলাদেশে The Evidence Act, 1872 (Act No. `1 of 1872) নামে পরিচিত। পরে The Law of Evidence Amendment Act, 1956 দ্বারা copie of common record এর জাবেদা নকল বিষয়ে The Evidence Act, 1872 এর ৭৪ ধারা নুতন বিষয়ে সংযোজন করা হয়।
এটি অবশ্য ১৫ আগষ্ট ১৮৪৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। এখনো সংসদ ও আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাক্ষ্য আইনের বিকাশ কার্যক্রম অব্যহত আছে।
সাক্ষ্য আইন সংক্রান্ত অন্যান্য বিধান
সাক্ষ্য আইনের প্রস্তাবনায় স্বীকার করা হয়েছে যে, ১৮৭২ সালের আইনটি ঐ সময়ে প্রচলিত আইনের একত্রীকরণ, সংঙ্গায়ণ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে রচিত। তবে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনকে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ (Exhustive Code) বলা যাবে না।
এজাহার বা এফ.আই.আর কি তা জানুন
দেখা যায়, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি ছাড়াও আরো বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষ্য সংক্রান্ত বিধান আছে। যেমন: দেওয়ানী কার্যবিধির ২৬ নং আদেশ সাক্ষ্য গ্রহণ বা স্থানীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য অনুসন্ধান করার ব্যাপারে দেওয়ানী আদালতকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন আইন দেখলে দেখা যাবে অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণের আগে আসামীকে নির্দোষ কল্পনা করার বিধানটির বেশ কিছু ব্যতিক্রম দেয়া আছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪১ অধ্যায়ে (ধারা ৫০৯ থেকে ৫১২) বেশকিছু সাক্ষ্য বিধি আছে।
Bankers Books Evidence Act 1891; Comercial Documents Evidence Act 1939; The Limitation Act, 1908, (Section 19 & 20) ইত্যাদি আইনগুলো সাক্ষ্য সম্পর্কিত অনেক বিধান আছে।
সাক্ষ্য আইনের প্রয়োজনীয়তা
প্রতিটি মামলার পক্ষ-বিপক্ষ থাকে তাই মামলার বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য সাক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিচারক উভয় পক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করেন।
উভয় পক্ষকে তাদের নিজ নিজ বক্তব্য অনুযায়ী নির্ধারিত বিচার্য বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বিচার্য বিষয় প্রমাণের বা মিথ্যা প্রমাণে সাহায্য করতে হয়। মামলার পক্ষগণ নিজেদের ইচ্ছেমত যেকোন বিষয়ে সাক্ষ্য উপস্থিত করতে পারেন না।
সাক্ষ্য উপস্থাপন করার কতিপয় নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। আর এই সকল নিয়ম কানুন সাক্ষ্য আইনে লিপিবদ্ধ আছে।
সাক্ষ্য আইনের বিষয়বস্তু
সাক্ষ্য আইন তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের প্রথম অধ্যায়ে এই আইনের প্রয়োগ ক্ষেত্র ও এই আইনে ব্যবহৃত কতিপয় শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ থেকে ৫৫ ধারা পর্যন্ত প্রাসঙ্গিকতার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগের তৃতীয় হতে ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৫৬ থেকে ১০০ ধারা পর্যন্ত বিচার্য বিষয় এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে কি ধরণের সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়া যাবে তার বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
তৃতীয় ভাগের অবশিষ্ট ৫টি অধ্যায়ে ১০১ থেকে ১৬৭ ধারা পর্যন্ত কিভাবে কি পদ্ধতিতে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে হবে তার বিধি বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
শেষাংশ
সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় ফৌজদারী কিংবা দেওয়ানী মামলায় সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব কতটুকু। কেবল সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য দ্বারাই একটি মামলার ফলাফল নির্ভর করে।
বর্তমানে সাক্ষ্য আইনটি বহু পুরানো হলেও এখনো এর গ্রহণযোগ্যতা বজায় আছে। বিভিন্ন আইনবিদরা এই সাক্ষ্য আইন পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দিয়ে থাকেন।
তথ্যসূত্র:
১. ‘সাক্ষ্য আইনের প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ’ – ইমতিয়াজ আহমেদ ও মোহম্মদ আল মামুন, সুফি প্রকাশনী “প্রথম সংস্করণ ২০১৫”
২. ‘সাক্ষ্য আইন’ – আমিনুল ইসলাম, সুফি প্রকাশনী, “চতুর্থ সংস্করণ ২০১৭”