তামাক চাষ : নদী ও বনাঞ্চলের মারাত্মক ক্ষতি

কক্সবাজার জেলার প্রধান দুই নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর দুই পাড় শুষ্ক মৌসুমে তামাক চাষে পরিপূর্ণ থাকে। কয়েকবছর আগেও নদীর পাড়ে তামাকের বদলে হতো সবুজ শাক-সবজীর চাষ। শুধু নদীর তীরেই নয় শুষ্ক মৌসুমে সাধারণ কৃষি জমিতেও চাষ করা হয়েছে তামাক।

তামাক চাষের তথ্য

রামু উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে ২০২২সালে ১৭০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। যদিও নদীর তীরে করা তামাক চাষের কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। অন্যদিকে চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস.এম নাসিম হোসেন জানান, এবারে চকরিয়ায় সর্বমোট ৬২০ হেক্টর জমিতে তামাক আবাদ করা হয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসগুলোর দেওয়া তথ্যমতে ফসলি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে এবার তামাক আবাদ করা হয়েছে। রামু উপজেলার রাজারকুল,মৌষকুম,গর্জনিয়া নাপিতেরচর,কাউয়ারখোপ, মনিরঝিল, ফাক্রিকাটা ঘুরে দেখা গেছে বাঁকখালী নদীর বুকে এবং দুই তীরে শুধুমাত্র তামাকের আবাদ। পাশাপাশি এসব এলাকার ফসলি জমিগুলোও তামাকের দখলে।

এদিকে চকরিয়া উপজেলার বোয়াবিলছড়ি,কাঁকড়া,ফাসিয়াখালী,মানিকপুর,সুরাজপুর ঘুরে দেখা গেছে একই অবস্থা। কক্সবাজারের প্রধান দুই নদী মাতামুহুরীর বুকে এবং দুই ধারে অসংখ্য তামাকের আবাদ চোখে পড়ে।

তামাক চাষ নিরুৎসাহে আইনের বিধান

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর ধারা ৫ ও ১২তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে তামাকজাত দ্রব্যের পৃষ্টপোষকতা ও তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন, ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণের শর্ত। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো এসবের কিছুই মানছেন না। তামাক চাষ প্রসারে উল্টো প্রণোদনা দিচ্ছেন কৃষকদের।

এই আইনের ১২ ধারায় উল্লেখ আছে, তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও উহার ব্যবহার ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করিবার জন্য উদ্বুদ্ধ, এবং তামাকজাত সামগ্রীর শিল্প স্থাপন, তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত, করিবার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবে।

পাশাপাশি ৫ ধারায় বলা হয়েছে, (১) কোন ব্যক্তি-

(ক) প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না;

(খ) তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে প্রলুব্ধকরণের উদ্দেশ্যে, উহার কোন নমুনা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে, জনসাধারণকে প্রদান বা প্রদানের প্রস্তাব করিবেন না বা করাইবেন না;

(গ) তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা উহার ব্যবহার উৎপাদিত করিবার উদ্দেশ্যে, কোন দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান, বা কোন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার (sponsor) বহন করিবেন না বা করাইবেন না;

(ঘ) কোন প্রেক্ষাগৃহে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বা ওয়েব পেজে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না;

(ঙ) বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত, বিদেশে প্রস্তুতকৃত কোন সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করিবেন না বা করাইবেন না:

তবে শর্ত থাকে যে, কোন সিনেমার কাহিনীর প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হইলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দৃশ্য রহিয়াছে এইরূপ কোন সিনেমা প্রদর্শনকালে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে লিখিত সতর্কবাণী, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, পর্দায় প্রদর্শনপূর্বক উহা প্রদর্শন করা যাইবে;

(চ) তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্য অন্য কোন দ্রব্য বা পণ্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার উৎপাদন, বিক্রয় বা বিতরণ করিবেন না বা করাইবেন না;

(ছ) তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে (point of sales) যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।

ব্যাখ্যা- উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, “তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার” অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো তামাকজাত দ্রব্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যে কোন ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।

(২) উপ-ধারা (১) এর দফা (ঙ) এর কোন কিছুই তামাক বিরোধী স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ক প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না।

(৩) কোন ব্যক্তি সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর (Corporate Social Responsibility) অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করিলে বা উক্ত কর্মকাণ্ড বাবদ ব্যয়িত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে কোন তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করিবে না বা করাইবে না অথবা উহা ব্যবহারে অন্য কোন ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদান করিবেন না।

(৪) কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করিলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হইবেন।]

এবারে কচ্ছপিয়ার নাপিতেরচরের কৃষক মো: আবদুস ছালাম মোট এক হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ করেছেন। তিনি জানান, একর প্রতি দশ হাজার টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। পাশাপাশি তামাকের বীজ, সার ও পোকা দমনে বিশেষ বিষও দিয়েছেন এই কোম্পানি।

তামাক চাষে কেমন খরচ হয়

কাউয়ারখোপের মনিরঝিলের কৃষক মো: হানিফের দেওয়া তথ্যমতে, এবছর মোট এক হেক্টরের কিছু কম জমিতে তামাকের আবাদ করেছেন তিনি। প্রতি ৪০ শতক জমি তিনি বর্গা নিয়েছে দশ হাজার থেকে পনের হাজার টাকায়। বীজ রোপনের আগে চাষে খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকা। তামাক রোপনে শ্রমিকের বেতন যাবে আরও ২৫০০ টাকা। টিউনেসিয়া, টিএসপি ও ইউরিয়া সারে খরচ পড়ে ৪৫০০ টাকা। তামাকের পরিচর্যা ও বিক্রি পর্যন্ত শ্রমিকে আরও খরচ যাবে ত্রিশ হাজার টাকা। তামাক বিক্রির আগে তা পোড়াতে খরচ পড়বে দশ হাজার টাকার অধিক।

অন্যদিকে মানিকপুর লামার পাড়ার কৃষক জলিল আহমেদ বলেন, তামাক চাষের মূল কারণ মোটা দাগে টাকা পাওয়া যায়। তাছাড়া তামাক কোম্পানি সুদমুক্ত ঋণ দেয়। নানান প্রকার সহায়তার কারণে শীতকালীন শাক-সবজীর চেয়ে তামাক চাষে লোকসানের চেয়ে লাভের আশা থাকে বেশি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবারে রামু ও চকরিয়া উপজেলায় মোট তামাক চাষের বেশিরভাগ তামাক সংগ্রহ করবেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো ও ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো। রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চকরিয়ায় তাদের বিক্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে সংগ্রহের প্রস্তুতি।

দূষিত হচ্ছে বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি

রামু ও চকরিয়া কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যে এই দুই উপজেলায় তামাক চাষের অধিকাংশ জমি শীতকালীন শাক-সবজি আবাদের জমি। শুষ্ক মৌসুমে বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর দুই তীরে একসময় শীতকালীন শাক-সবজী হলেও এবারে ৮০শতাংশ নদীর বুক ও পাড় দখল করে আছে তামাক।

যদিও নদীবেষ্টিত এসব এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নদীর আশেপাশে তামাক চাষ না করতে সরকারি নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড দেখা গেছে। কিন্তু নির্দেশনার কোন কিছুই মানছেন না স্থানীয় কৃষকেরা।

ভোক্তা অধিকার আইনে ভোক্তার অধিকার কি

নদীর বুকে ও তীরে তামাক চাষের ফলে কি ক্ষতি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিভারাইন পিপল’র মহাসচিব শেখ রোকন জানান, তামাক চাষের ফলে প্রধানত আমাদের প্রতিবেশগত ক্ষতিটা হবে বেশি। দিন দিন এই চাষ বৃদ্ধির ফলে আমদের উৎপাদনমুখী কৃষি ও ভয়াভয় কীটনাশক ব্যবহারে নদীর পানি ও মাছের স্থায়ী ক্ষতি হবে যা অপূরণীয়।

কক্সবাজারে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল

কক্সবাজার জেলাজুড়ে রামু ও চকরিয়ায় তামাকের আবাদ সবচেয়ে বেশি হলেও তামাক বিক্রির আগে তামাক পোড়ানোর কাজে ব্যবহার হওয়া লাকড়ি আসে টেকনাফ, ফাঁসিয়াখালী ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন বনাঞ্চল থেকে।

সূত্রমতে প্রতি ৪০ শতক জমির তামাক পোড়াতে ৫০মণ লাকড়ি প্রয়োজন। সে হিসেবে এবছর মোট ৭৯০হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তামাক পোড়াতে প্রায় দশ হাজার টনের বেশি লাকড়ির প্রয়োজন হবে। যার অধিকাংশ যোগান দিবে বনাঞ্চল থেকে কাঁটা গাছ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক জিয়াউর রহমান কল্লোল অনুসন্ধানকে জানান, বাঁকখালী নদীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা চেয়ে বেলা ইতোমধ্যেই একটি জনস্বার্থে মামলা করেছে এবং আদেশও পেয়েছে কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতা না থাকলে আসলে বাস্তবায়ন অসম্ভব। পাশাপাশি বন উজাড় রোধে আমাদের কাজ চলমান।

তথ্য অনুসন্ধান

শুষ্ক মৌসুমে শীতকালীন সবজি চাষ বাদ দিয়ে তামাক চাষে ঝুঁকেছে বেশিরভাগ কৃষক। এর মূল কারণ হিসেবে শীতকালীন শাক-সবজির দাম না পাওয়াকে দুষছেন একাধিক কৃষক। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো অগ্রিম ঋণ ও কৃষি সহায়তা দেওয়ায় তামাক চাষে জিম্মি হয়ে পড়েছে কৃষকেরা।

এখন চাইলেও শীতকালীন শাক-সবজি চাষ অসম্ভব কারণ তামাক কোম্পানিগুলো গ্রামীণ পর্যায়ে মাঠকর্মী নিয়োগ করে তামাক চাষে নানান উদ্ভুদ্ধকরণ প্রচার ও প্রসার চালাচ্ছে। সাধারণ কৃষক অধিক মুনাফা এবং বড় অংকের টাকার লোভে ঝুঁকছে তামাক চাষে।

একাধিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে তামাক চাষে কৃষকের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাঁড়ছে। ক্যান্সার ও ফুসফুসের অসুখ দেখা দিবে। শুধুমাত্র কৃষকেরই নয় তামাক আবাদের এলাকাজুড়ে তৈরি হবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি।

যে পদক্ষেপ জরুরী

কক্সবাজারের প্রধান দুই নদীর জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকারিভাবে হস্তক্ষেপ জরুরী। সরকারিভাবে যদিও এই দুই নদীবেষ্টিত এলাকায় নদীর তীরে তামাক চাষ না করতে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেসব তদারকি করার কেউ নেই।

স্থানীয় প্রশাসন এবং বে-সরকারি সংস্থাগুলো জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম বাড়ালে রোধ করা যেতে পারে তামাক চাষ। পাশাপাশি তামাকের চাষ নিরুৎসাহিতকরণে আরও যুগপোযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ উচিৎ।

এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন অসীম বড়ুয়া, মো: সাইদুজ্জামান ও কফিল উদ্দিন।

শিপ্ত বড়ুয়া
শিপ্ত বড়ুয়া
শিপ্ত বড়ুয়া কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.বি(অনার্স) ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.এম সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি লিগ্যাল হোমে আইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অনলাইনে আইনী পরামর্শ প্রদান ও সরাসরি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি।

মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য
আপনার নাম
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

আরও লেখা

You cannot copy content of this page