ফৌজদারী শব্দটি একটি ফারসি শব্দ। মূলত ফৌজ হলো আরবি শব্দ আর দারী শব্দটি ফারসি। ফৌজদারী মামলা বলতে বুঝায় যেসব কাজ করা বা না করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে সেসব কাজ করলে বা না করলে দন্ডমূলক বিচারের প্রস্তাব করা।
আমরা সাধারণ মানুষ ফৌজদারী মামলা শব্দটির চেয়ে ক্রিমিনাল কেস বললেই ভালোভাবে বুঝতে পারি। আজকের এই আলোচনায় থাকবে একটি ফৌজদারী মামলা কিভাবে হতে পারে এবং এইসব মামলাসমূহ আদালতে কিভাবে বিচার করা হয়।
এই লেখায় আছে
ফৌজদারী মামলার প্রকারভেদ
ফৌজদারী মামলা বা ক্রিমিনাল কেস সাধারণত দুইভাবে হতে পারে। থানায় এবং আদালতে। যেসব অপরাধ গুরুতর সেসব অপরাধে সচরাচর থানায় মামলা নেওয়ার বিধান আইনে আছে। পাশাপাশি থানা মামলা না নিলেও আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটর নিকট গিয়ে মামলা করার বিধানও আইনে আছে।
যেসব মামলা থানায় হয় সেসব মামলাকে G.R Case (জি.আর মামলা বা জেনারেল রেজিস্টার্ড কেস) এবং যেসব মামলা আদালতে বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দায়ের করা হয় সেসব মামলাকে C.R Case (সি.আর মামলা বা কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার্ড কেস) বলা হয়।
প্রিয় পাঠক জি.আর (G.R) ও সি.আর (C.R) মামলা কি? এনিয়ে আমাদের আগের একটি আলোচনা আছে। এই লেখাটি পুরো পড়ার আগে আপনি যদি জি.আর এবং সি.আর মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে লিংকে দেওয়া আগের লেখাটি পড়ে আসুন।
ফৌজদারী মামলার বিচার কোন আদালতে হয়?
ফৌজদারী মামলার বিচার সাধারণ দু’টি আদালতে হয়ে থাকে। ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ও দায়রা আদালতে। মূলত ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী এই দুই আদালতে ফৌজদারী বা ক্রিমিনাল কেসের বিচার হয়।
এখন আরও একটি প্রশ্ন আসতে পারে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং দায়রা আদালত কি? এই দুই ফৌজদারী আদালতের গঠন ও বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে এর আগে আমাদের আরো একটি আলোচনা আছে। এই দুই আদালত সম্পর্কে আপনার ধারণা না থাকলে লিংকে ক্লিক করে আগের আলোচনাটি পড়ে আসার অনুরোধ রইলো।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া
ফৌজদারী কার্যবিধি সম্পূর্ণ একটি বিধি-বিধান যেখানে ফৌজদারী মামলা কিভাবে পরিচালিত হবে বা বিচার হবে তার ব্যখ্যা দেওয়া হয়েছে। যখন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কোন অভিযোগ গ্রহণ করেন, এরপরেই মামলার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে গুণাগুণ অনুযায়ী অনুসন্ধান/তদন্তের আদেশ দিতে পারেন।
অথবা মামলা সম্পর্কে কোন সন্দেহ না থাকলে সরাসরি মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির ২য় তফসিলের ৪নং কলামে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী অভিযুক্তের প্রতি সরাসরি হাজিরের সমন/গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন।
এরপরেই আসামী হাজির হলে বিচারিক ক্ষমতা অনুযায়ী মামলা নিজেই বিচার শুরু করবেন বা অন্য আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করবেন।
যদি মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নিজে বিচারের এখতিয়ারের মধ্যে থাকে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চার্জ গঠন বা অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্টানিক বিচার শুরু করবেন।
এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা জরুরী। চার্জ গঠনের প্রাথমিক শুনানীর সময় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চাইলে আসামীকে মামলা থেকে অব্যহতি দিতে পারেন।
কখন মামলা থেকে আসামীকে অব্যহতি দেন?
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪১(এ) ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট চার্জ গঠনের সময় মামলার নথি ও মামলার অন্যান্য কাগজপত্র বিবেচনা করে এবং আসামীর পক্ষে আইনজীবীর বক্তব্য শুনার পর আদালত যদি মনে করেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা চালানোর মতো পর্যাপ্ত কোন কারণ নেই তাহলে আসামীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন না করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মামলা থেকে অব্যহতি(Discharge) দিতে পারবেন।
তবে আইনের বিধান অনুযায়ী অব্যহতি পাওয়ার আবেদনে আসামীর দেওয়া কোন দলিলপত্র বা কাগজপত্র আদালত বিবেচনা করবেন না।
মামলার চার্জ গঠন ও সাক্ষ্য গ্রহণ
এবার মামলার নথিপত্র বিবেচনায় ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে, আসামী অপরাধ করেছে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে তবে তিনি আসামীর বিরুদ্ধে অভিযুক্ত অপরাধের জন্য আনুষ্টানিক চার্জ গঠন করবেন।
চার্জ গঠনের সময় মূলত আদালত আসামীকে জিজ্ঞাসা করেন যে, অভিযোগের সময়, তারিখ, স্থান ও যাদের বিরুদ্ধে যেসব ধারায় অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে সেসব অভিযোগ তিনি স্বীকার করেন কিনা?
আসামী এই পর্যায়ে দোষ স্বীকার করতেও পারে আবার অস্বীকার করতেও পারে।
আসামী যদি দোষ স্বীকার করে তাহলে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৩ ধারার অধীন দোষ স্বীকারের ভিত্তিতে আসামীকে দন্ড দিবেন।
আসামী যদি চার্জ গঠনের সময় দোষ স্বীকার না করে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদী পক্ষের সাক্ষী গ্রহণ শুরু করবেন। তাছাড়া আসামীর আত্মপক্ষ সমর্থনে সাক্ষ্যও এই পর্যায়ে গ্রহণ করবেন।
সমস্ত সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলার গুণাগুণ বিচারে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামী নির্দোষ প্রমাণ হলে খালাস বা দোষী প্রমাণ হলে দন্ড দিবেন।
দায়রা আদালতে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া
ফৌজদারী মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার সাথে দায়রা আদালতের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় একই। তবে ফৌজদারী কার্যবিধির আলালা আলাদা ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং দায়রা আদালতের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সাধারণত দায়রা আদালতে সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন পি.পি বা পাবলিক প্রসিকিউটর।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(এ) থেকে ২৬৫(কে) ধারায় দায়রা আদালতে কিভাবে একটি ফৌজদারী মামলার বিচার কাজ চালাবে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে।
দায়রা আদালত সাধারণত কোন মামলার আমল গ্রহণ করেন না। এটা শুধুমাত্র বিচারিক আদালত। সাধারণ কোন মামলা আমলে গ্রহণ করেন ম্যাজিস্ট্রেট। অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কোন মামলা আমলে গ্রহণের পর থেকে মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুতের পর যদি ফৌজদারী কার্যবিধির ২য় তফসিলের ৮ম কলামে বিচারিক আদালত দায়রা আদালত হয়ে থাকে তাহলে চার্জ গঠণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি দায়রা আদালতে পাঠাবেন। চার্জ গঠনের আগ পর্যন্ত যা যা কার্যক্রম তা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত করে থাকেন এবং এটাই বিচারের আগের প্রক্রিয়া।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে বদলি হয়ে কোন ফৌজদারী মামলা যখন দায়রা আদালতে বিচারের জন্য আসে তখন ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(সি) ধারা মতে প্রাথমিক শুনানীর পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামীর বিরুদ্ধে মামলা চালাবার মতো পর্যাপ্ত কোন কারণ নেই তবে তিনি আসামীকে অব্যহতি দিতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মতোই একইভাবে দায়রা আদালত যদি মনে করেন যে, আনীত অভিযোগে আসামী অপরাধ করেছে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে তাহলে তিনি চার্জ বা অভিযোগ গঠন করবেন। দায়রা আদালতের চার্জ গঠন প্রক্রিয়াও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মতোই একই।
ফৌজদারী মামলায় আসামী যদি দোষ স্বীকার করে তাহলে সে অনুযায়ী দায়রা আদালত শাস্তি দিবেন আর যদি দোষ স্বীকার না করলে বাদী পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করবেন।
এরপর আসামী পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন আদালত। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলার গুণাগুণে যুক্তিতর্ক করবেন উভয় পক্ষ। যুক্তিতর্কের পর আদালত খালাস বা দন্ডের রায় দিবেন।
আদালত বাদী/রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ও আসামী পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আসামী অপরাধ করেছে এরকম কোন প্রমাণ না হলে আদালত আসামীকে খালাস দিবেন। অথবা রাষ্ট্রপক্ষ যদি সাক্ষীদের হাজির করতে না পারেন ২৬৫(এইচ) ধারানুযায়ী আসামী মামলা থেকে খালাস পাবেন।
ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির সময়
ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯(সি) ধারায় বলা আছে ম্যাজিস্ট্রেট মামলা বিচারের জন্য পাওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করবেন। এবং দায়রা আদালত সমূহ বিচারের জন্য পাওয়ার ৩৬০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করবেন।
আইনে এই বিধান থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা সচরাচর দেখতে পাই কোন ফৌজদারী মামলা পাঁচ-দশ বছরের আগে শেষ হয়না। এক্ষেত্রে এজন্য এই একই ধারায় বলা হয়েছে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে যদি আদালত মামলার বিচার কাজ শেষ করতে না পারে তাহলে সন্তুষ্টি সাপেক্ষে আদালত আসামীকে অজামিনযোগ্য ধারায়ও জামিন দিতে পারেন।
ফৌজদারী মামলায় আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের বিধান
আদালত যখন কোন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন তখন অবশ্যই আসামীর উপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। আসামী যদি সেসময় কারাগারে আটক থাকে তাহলে আদালতে উপস্থিত রাখতে হবে। অথবা যদি জামিনে থাকেন তাহলেও আসামীকে হাজির থাকতে হবে।
শেষকথা
উপরের আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও দায়রা আদালতে একটি ফৌজদারি মামলা কিভাবে বিচার হয় সে সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
যদিও এই লেখায় আরও নানা বিষয় আলোচনার দরকার ছিলো। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ধন্যবাদ। কোন প্রশ্ন?
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন: https://www.youtube.com/channel/UCzKL7AcBsC06qCPb3sEKX4Q