মঙ্গলবার, মার্চ ২৬, ২০২৪

মোবাইল কোর্ট কি? : মোবাইল কোর্টের দন্ড বে-আইনি হলে করণীয় কি?

মোবাইল কোর্ট হলো বাংলাদেশ সরকার প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বাইরেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধকে আরো গতিশীল করতে একধরণের কোর্ট ব্যবস্থা যা মোবাইল কোর্ট নামে পরিচিত। মোবাইল কোর্টের মূল কাজ হচ্ছে অপরাধের ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ আমলে নিয়ে শাস্তি প্রদান করা। মোবাইল কোর্টের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিস্তারিতভাবে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এ উল্লেখ আছে।

মোবাইল কোর্টের বিচারক কে?

মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর ধারা ৫ অনুযায়ী সরকার সারাদেশ অথবা যেকোন একটি নির্দিষ্ট জেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকায় যেকোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে এবং ডিস্ট্রিক্ট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার আঞ্চলিক এখতিয়ারের অধীন যেকোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিত আদেশ দ্বারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার ক্ষমতা প্রদান করতে পারেন।

সুতরাং, এই ধারা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ সচরাচর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেন।

নির্বাহী বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কারা?

বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী দেশে দুই ধরণের ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে। জুডিসিয়াল বা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও এক্সিকিউটিভ বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকেও ফৌজদারী আদালত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ১০ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও কার্যাবলি সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী সরকার প্রত্যেক জেলায় ও মেট্রোপলিটন এলাকায় যে সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন মনে করবেন তা নিয়োগ দিতে পারেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির ১০ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে সরকার যদি প্রয়োজন মনে করেন তবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) এ নিয়োজিত যে কোন ব্যাক্তিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন এবং উক্ত যেকোন সদস্যকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।

আইনজীবী হতে চাইলে লেখাটি পড়ুন..

একই ধারার ৬ উপধারায় বলা হয়েছে উপধারা ৪ এর অধীনে স্থানীয় সীমা চিহ্নিতকরণ সাপেক্ষে কোন জেলায় বা উপজেলায় সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গণ্য হবে। তাছাড়া তাদের স্থানীয় সীমার মধ্যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

তাছাড়া, ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১২ অনুযায়ী সরকার চাইলে নির্দিষ্ট কোন সময়কালের জন্য যে কাউকে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সকল বা আংশিক কোন ক্ষমতা অর্পন করতে পারে। যদিও এখানে কিছু শর্ত আছে।

শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়, এরকম বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটকে সরকার চাইলে হাইকোর্ট বিভাগের সাথে পরামর্শক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সকল বা আংশিক ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে।

নিশ্চয় এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে যে সচরাচর কে বা কারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা পেতে পারে।

মোাবাইল কোর্ট কোন কোন অপরাধের বিচার করতে পারে?

মোবাইল কোর্ট আইনের ধারা ৬ অনুযায়ী মোবাইল কোর্টকে বেশ কিছু অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের ধারা ৫ ও ১১ এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোন অপরাধ যা কেবল জুডিসিয়াল ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য তা ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে বিচার করতে পারেন।

একটু লক্ষ্য করুন, তফসিলে বর্ণিত অপরাধের কথা বলা হয়েছে। মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, দন্ডবিধি’র উনপঞ্চাশটি নির্দিষ্ট ধারার অপরাধ উক্ত তফসিলে দেওয়া আছে। তাছাড়া এই মূল আইন ছাড়া বিশেষ ১১০(একশত দশটি) বিশেষ আইনের অধীন অপরাধ আমলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট বিচার করতে পারেন।

তার মানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অনেক আইনের আলোকে তাৎক্ষণিক অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার করতে পারে।

মোবাইল কোর্টের দন্ড ও জরিমানা আরোপের এখতিয়ার কতটুকু?

যদিও উক্ত আইনের তফসিলে বর্ণিত অনেক আইনের উল্লেখিত অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার মোবাইল কোর্টকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই আইনের ধারা ৮ ও ৯ এর মাধ্যমে মোবাইল কোর্টকে দন্ড ও জরিমানা আরোপের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

মোবাইল কোর্ট সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দিতে পারে এমনকি তফসিলবর্ণিত আইনে কোন অপরাধে এর বেশি দন্ড থাকলেও দুই বছরের বেশি কারাদন্ড মোবাইল কোর্ট দিতে পারেন না। মোবাইল কোর্ট জরিমানা আরোপ করবেন সংশ্লিষ্ট আইনে উল্লেখিত অর্থদন্ডের সীমার মধ্যে, এর বেশি নয়।

তাছাড়া কারাদন্ড ও জরিমানা আদায় ফৌজদারী কার্যবিধির নিয়ম অনুযায়ী হবে বলে উল্লেখ আছে।

মোবাইল কোর্টের দন্ড বে-আইনি হলে করণীয় কি?

মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী আপিল

লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্স ও সংবিধান মোতাবেক আইন সকলের জন্য সমান এবং এর কোন সীমানা নেই। আদালতের শ্রেণী অনুযায়ী নিম্ন আদালত থেকে বিচার শুরু হয়ে রায় হলে সে রায়ের আপিল করে সু-বিচার পাওয়ার সুযোগ আইনে আছে এবং এটা প্রাকৃতিক।

মোবাইল কোর্ট দ্বারা যদি কোন কারাদন্ড কিংবা অর্থদন্ড যদি আপনার কাছে বে-আইনি মনে হলে আপনি সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন।

মোবাইল কোর্ট আইনের ১৩ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীন আরোপিত কোন দন্ড দ্বারা যদি কোন ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হয় তাহলে জেলা বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে আপিল দায়ের করতে পারেন।

আবার আপিল দায়েরের পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর রায়ে সন্তুষ্ট না হলে বা এরূপ রায়ও বে-আইনি মনে হলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপনি দায়রা জজের কাছে আপিল দায়ের করতে পারেন।

ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রদত্ত প্রতিকার

ফৌজদারী কার্যবিধি’র ৪৩৫ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত কোন দন্ড বে-আইনি হলে এবং তা যদি হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজের গোচরীভূত করা হয় তাহলে তাঁর অধিক্ষেত্রের অধীন উক্তরূপ রায়ের নথি তলব করে যেকোন প্রকার দন্ড স্থগিত বা আসামী আটক থাকলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে। ৪৩৫ ধারার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সকল ম্যাজিস্ট্রেট দায়রা জজের অধস্তন বলে গণ্য হয়।

এছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা জজ ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪৩৯ ও ৪৩৯(ক) অনুযায়ী, কোন মামলার নথি তলব করে থাকলে বা অন্য কোনভাবে উক্ত বিষয় নজরে আসলে হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজ ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪২৩, ৪২৬, ৪২৭ এবং ৪২৮ অনুযায়ী আপীল আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ করে কোনো আসামীর খালাস, দন্ড হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারেন।

সাংবিধানিক প্রতিকার

মোবাইল কোর্ট প্রদত্ত কোন বেআইনী বা অসাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৩, বাংলাদেশ সংবিধান) যার কোন একটি লঙ্গন হয়েছে মনে হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগে দন্ডাদেশ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন।

শেষকথা

পাঠক উপরের লেখার মাধ্যমে আপনাকে মোবাইল কোর্টের সংক্ষিপ্ত কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র যা আপনার জানা জরুরী, কোনভাবেই এই লেখায় মোবাইল কোর্ট সম্পর্কে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা হয়নি। পরিশেষে বলতে চাই মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর অধীন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে একধরণের বড় বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দুই বছরের কারাদন্ড দিতে পারে অনায়াসেই। সচরাচর বর্তমান সময়ে খবরের কাগজে মোবাইল কোর্টের ক্ষমতার অতিচর্চা সম্পর্কে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই লেখার মাধ্যমে নিশ্চয় আপনি মোাবাইল কোর্ট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন।

কোন প্রকার ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে অবশ্যই বিজ্ঞ একজন আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিন। কোনভাবেই নিজে নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। আইন খুবই সুক্ষ্ম বিষয়। আইনের সঠিক বিচার ও বিশ্লেষণ দেখাতে পারে নতুন কোন পথ।

অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
শিপ্ত বড়ুয়া কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.বি(অনার্স) ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.এম সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অ্যাডভোকেট ও লিগ্যাল হোমে আইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অনলাইনে আইনী পরামর্শ প্রদান ও সরাসরি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য
আপনার নাম

আরও লেখা

যেভাবে আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন

আইন পাশ করার পর একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের জায়গায় থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা। দিন যত...

ফৌজদারী মামলায় জামিন যেভাবে পাওয়া যাবে

কোন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। কোন ফৌজদারী মামলায় জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে মনে...

সমাজসেবা অধিদপ্তরে সংস্থা/সংগঠন নিবন্ধনের নিয়ম

স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠন বা সংস্থাসমূহকে সরকারি নিবন্ধন দেওয়ার কাজ সমাজসেবা অধিদপ্তরের। আজকের লেখায় সংগঠন নিবন্ধন করার নিয়ম সম্পর্কে...

ফৌজদারী মামলায় আপিল করবেন যেভাবে

ফৌজদারী মামলায় আপিল সম্পর্কে আইনে সুর্নিদিষ্ট বিধান আছে। ধরুন ফৌজদারী মামলায় একটি রায় হলো, আপনি বাদী কিংবা বিবাদী...

You cannot copy content of this page