শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

গ্রেফতার এবং পুলিশ রিমান্ড কি? কেন?

আজকের লেখায় গ্রেফতার ও রিমান্ড কি সে বিষয়ে আলোচনা করবো। রিমান্ড ও গ্রেফতার সম্পর্কে  অনেকের ভুল ধারণা আছে। একটি দেশের জন্য তিনটি অঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যথা আইন প্রণয়ন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ। একটি অঙ্গ আরেকটির সাথে জড়িত এবং একইসাথে কাজ করে এই বিভাগগুলো। বিশেষ করে শাসনবিভাগ সরাসরি জনমানুষের সাথে সম্পৃক্ত।

বিচার বিভাগ মানে আদালতের আদেশ কার্যকর করতে তারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে। শাসন বিভাগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে সাধরণত পুলিশকে আমরা গুরুত্বসহকারে এবং প্রাথমিকভাবে দেখে থাকি। এরমধ্যে অনেকবার সরাসরি পুলিশের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেখা গেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অনেক সদস্য বেশবার তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্গনের কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন।

আমরা দেখে থাকি বর্তমান যুগে এসেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে রিমান্ড সংঙ্গা হলো, দোষ স্বীকার করানোর জন্য পুলিশের অমানবিক নির্যাতন এবং এটা পুশিশের আইনি অধিকার বলে জানেন সাধারণ মানুষ।

আরও আশ্চর্য বিষয় মানুষ এটা মেনে নিয়েছে যে আদালতের আদেশ ছাড়াই পুলিশ যেকোন মুহুর্তে গ্রেফতার করে নির্যাতন করলে আমাদের কিছু করার নেই। এটা অবশ্য সত্য যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারার অপব্যবহার আমাদের দেশে অনেক বেশি হয়েছে, তাই মানুষ এমন ভাবা শুরু করেছে।

আপনি যদি সরাসরি এসব না দেখেন অথবা বাস্তবিক অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে ভোক্তভোগীদের অবস্থা বুঝতে পারবেন না। প্রত্যেক মানুষের জীবনের অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং আত্মরক্ষার অধিকার সংবিধান নিশ্চিত করেছে এবং মৌলিক অধিকার হিসেবেই নিশ্চিত করেছে। আমরা আমাদের এই অধিকারগুলো নিয়ে সচেতন নয় বলেই সবলেরা আমাদের আক্রমণ করছে এবং এটা নিয়মিত হয়ে দাড়িঁয়েছে।

আমজনতার অজ্ঞতার এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ফাঁক-ফোকরের সুযোগে বেশিরভাগ অসৎ পুলিশ গ্রেফতার এবং রিমান্ডের চরম অপব্যবহার করছে যা বর্তমানে ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনকে মানবাধিকার লঙ্গনের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংবাদ সংস্থা। একটা কেস রেফারেন্স দিই যেটা দেশে রীতিমতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা ( ৫৫ ডি.এল.আর ৩৬৩), এই মামলায় উচ্চ আদালতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন এবং রীতিমতো শঙ্কা প্রকাশ করেছিলো।

পুলিশ এবং নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ এবং ১৬৭ ধারার ভয়াভয় অপব্যবহার নিয়ে মহামান্য আদালত বিশদ বর্ণনা করেছিলো। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারার অধীন পুলিশ কর্তৃক আটক ব্যক্তির কাছ থেকে অপরাধের বিশদ বর্ণনা এবং তথ্য বের করার উপায়কে ভয়াভয় এবং বেশিরভাগ সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবেও দেখেছিলো মহামান্য আদালত।

ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় রায় দিতে গিয়ে পুলিশ দ্বারা গ্রেফতার এবং আটকের ব্যবস্থা আরো পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকারকে পনেরোটি সুপারিশ করেছিলো হাইকোর্ট বিভাগ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহামান্য আদালতের এসব সুপারিশকে সরকার তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি এবং বাস্তবতায় পুলিশ বাহিনীও তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে গিয়ে এসব তোয়াক্কা করেনা।

মদ পানের লাইসেন্স করতে করণীয়

আপনি যদি বেশিরভাগ আমজনতার কাছে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ বা পুলিশ রিমান্ড কি বিষয়ে প্রশ্ন করেন, সবচে বেশি উত্তর আসবে এরকম যে, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ মানে অপরাধীর কাছ থেকে  অপরাধের বর্ণনা অথবা অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য অমানবিক নির্যাতন, যদিও আইনে আছে রিমান্ড মানে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ।

এমনকি আইনে কোথাও উল্লেখ নেই পুলিশের মারধরের কোন ক্ষমতা নিয়ে। আটক অথবা গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশের অবশ্যই বল প্রয়োগের দরকার পড়বে এটা আইনসিদ্ধ, এটাই স্বাভাবিক কিন্তু বল প্রয়োগ এতটাই নির্মম হয় যা কোনভাবেই কাম্য নয়।

সে একই ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় দেখেছি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়েও সুপারিশ করেছিলো। আমি মনে করি আমাদের যে পরিমাণে আইন আছে তা কোনভাবেই কম নয়, সমস্য হলো এই আইনগুলোর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না বরং এসবের অপপ্রয়োগ হচ্ছে বেশি।

পুলিশ জনগণের রক্ষক এবং এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক ভালো মানুষ দরকার, কারণ তাদের হাতেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নির্ভর করে। হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের পরে বর্তমানে নিম্ন আদালতগুলোতে দেখা যায় পুলিশ রিমান্ডের আগে পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়, প্রশ্ন হলো এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা কতটুকু নিরপেক্ষ হয় বা আদৌ হয় কিনা !

মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের এই সুপারিশের পেছনে মূল কারণ ছিলো জনমানুষের কাছে রিমান্ড নিয়ে যে সংকোচ এবং ভয় তা দূর করা এবং পুলিশের নির্মম নির্যাতন থেকে অভিযুক্তকে নিরাপদ রেখে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

এতসবের মানে কি? এমনকি হাইকোর্ট বিভাগ পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডের নির্যাতন নিয়ে অনেক মামলায় প্রমাণ পেয়েছে নাহয় এহেন সুপারিশ আমাদের দেখতে হতো না। এটি পুলিশ বাহিনীর জন্য লজ্জার এবং ভয়ের বটে। আমি মনে করি বেশিরভাগ পুলিশ যেহেতু তাদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ নীতির সাথে মারামারি মারামারি খেলা খেলছে সেহেতু পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ আরো আধুনিক এবং বিশেষভাবে হওয়া উচিৎ, এটা আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে হতে পারে।

আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে এবং পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সরকারের আরো গুরুত্ববান হওয়া উচিৎ, তাছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের পরামর্শক্রমে পদক্ষেপ নেওয়া এইমুহুর্তে জরুরী।

জরিপ করলে দেখা যাবে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারার অধীন অনেকগুলো অবৈধ গ্রেফতার হয়েছে এবং নিয়মিত হচ্ছে । কিছু অসৎ পুলিশ নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে এবং নিজের ক্যরিয়ার র‌্যাঙ্ক বাড়াতে অনেক নিরপরাধকে গুরুতর ফৌজদারী মামলায় নাম লেখিয়ে দেয় যা আমরা বিভিন্ন সময় টেলিভিশন এবং পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখে থাকি।

গত কয়েকমাসের খবর পর্যালোচনা করলে আপনারা দেখবেন কতগুলো অবৈধ আটক আছে এবং পুলিশের নির্মম নির্যাতনে কতগুলো কাস্টডিয়াল ডেথ আছে এবং পরবর্তীতে তা সব ময়না তদন্তে মারধরের প্রমাণ মিলেছেও।

পুলিশ যেহেতু দেশের শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষার নিয়োজিত প্রধান বাহিনী, এই বাহিনীতে অনেক সৎ মানুষের দরকার এবং তাদের ক্ষমতার চর্চার সময় আরো দায়িত্ববান হতে হবে। পুলিশের সচরাচর এসব ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের পবিত্র সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক শান্তি কনভেনশনগুলোর সরাসরি লঙ্গন।

আরো কিছু মামলার এবং ঘটনার উদহরণ দিই যা থেকে স্পষ্ট ভেসে উঠে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কি ভয়াভয়ভাবে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এদেশে করেছে।  আপনারা নিশ্চয় ভুলে যাননি লিমন হোসাইনের ঘটনা, ঝালকাঠিতে র‌্যাবের নির্মম নির্যাতন দেশকে ভয়ের মুখে ফেলে দিয়েছিলো।

তারপর আব্দুল কাদের মামলা, পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদেরকে ডাকাতিসহ কয়েকটি অভিযোগে আটক করে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় তদন্ত এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর যৌথ তদন্তে বেরিয়ে আসে আব্দুল কাদের সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছিলো তাকে ফাঁসানো হয়েছিলো।

এরকম আরো কতো ঘটনা আছে যা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আঢালেই থেকে গেছে। সুতরাং উপরের এতসব ঘটনার সংক্ষেপ করলেই আমরা খুঁজে পাই বাংলাদেশ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারের অনেক ইতিহাস জমা হয়ে আছে। এসব ইতিহাস আমাদের কোন বাংলাদেশের ইঙ্গিত করে?

সর্বশেষে এটাই বলতে চাই আটক এবং গ্রেফতারের বাস্তবিক চলমান ধারণা যতদ্রুত সম্ভব পরিবর্তন হওয়া উচিৎ তাহলেই আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনমানুষের শ্রদ্ধা এবং আস্থা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে আইন গবেষকদের দ্বারা আরো বেশি বেশি গবেষণা হওয়া দরকার পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে।

আমরা যারা আইনের শিক্ষক এবং ছাত্র ও আইন পেশায় জড়িত রয়েছি আইনের ফাঁক-ফোকর নিয়ে আমাদের আরো বেশি সুসংগঠিত আলোচনা দরকার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একদিন আটক, গ্রেফতার নিয়ে মানুষের চলমান চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আসবে এবং পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ হবে।

লক্ষ লক্ষ বিচারপ্রার্থী পাবে তাদের ন্যয্য বিচার। পূথিবীর সকল মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, সকল প্রাণী সুখী হোক।

তথ্যসূত্র: ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা বাই আব্দুল হালিম, একাডেমিয়া ডট এডু, সাংবিধানিক আইন বাই মাহমুদুল ইসলাম, ব্লাস্ট ডট অর্গ ডট বিডি ও অন্তর্জাল।

অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
শিপ্ত বড়ুয়া কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.বি(অনার্স) ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.এম সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অ্যাডভোকেট ও লিগ্যাল হোমে আইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অনলাইনে আইনী পরামর্শ প্রদান ও সরাসরি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য
আপনার নাম

আরও লেখা

যেভাবে আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন

আইন পাশ করার পর একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের জায়গায় থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা। দিন যত...

ফৌজদারী মামলায় জামিন যেভাবে পাওয়া যাবে

কোন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। কোন ফৌজদারী মামলায় জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে মনে...

সমাজসেবা অধিদপ্তরে সংস্থা/সংগঠন নিবন্ধনের নিয়ম

স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠন বা সংস্থাসমূহকে সরকারি নিবন্ধন দেওয়ার কাজ সমাজসেবা অধিদপ্তরের। আজকের লেখায় সংগঠন নিবন্ধন করার নিয়ম সম্পর্কে...

ফৌজদারী মামলায় আপিল করবেন যেভাবে

ফৌজদারী মামলায় আপিল সম্পর্কে আইনে সুর্নিদিষ্ট বিধান আছে। ধরুন ফৌজদারী মামলায় একটি রায় হলো, আপনি বাদী কিংবা বিবাদী...

You cannot copy content of this page