শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলাচল নিয়ন্ত্রণে আইন

কভিড-১৯ অথবা করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক রোগ যার সংক্রমণ হয় শারিরীক দুরত্ব বজায় না রাখলে মানে শারিরীক সংঘবদ্ধ থাকলে। বর্তমানে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস বাংলাদেশে ভয়াভয় রূপ নিতে যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে হাজারের অধিক লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত।

বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে এখনো করোনাভাইরাস নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি এবং এর প্রধান তিনটি কারণ সনাক্ত করা যেতে পারে। প্রধানত বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র এবং ধর্মভীরু ও কুসংস্কারছন্ন এবং তথাকথিত অবহেলাপ্রবণ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু দরিদ্র, দিন মজুর তারা বাইরে কর্মের জন্য বের না হয়ে একদিনের বেশি ঘরে বসে খেতে পারবে না তার মানে তাদের নিয়ম করেই কাজে যেতে হবে।

তার পরিবর্তে তাদের ঘরে রাখতে চাইলে মানে সংঘরোধকল্পে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা মেঠাতে হবে সরকারকে। দরিদ্র মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন মেঠাতে ইতিমধ্যে সরকার নানান পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে এবং এটা খুশির খবর, দুঃখের বিষয় নিম্নস্থরের বিভিন্ন চোরদের কবলে পড়ে সে পদক্ষেপ সফলতার মুখ দেখছে না, সরকারের ঘোষিত ত্রান চুরির ঘটনার কারণে। অন্যদিকে করোনা মেকাবেলায় এশিয়া মহাদেশের সব’চে বড় চ্যালেন্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মভীরুতা ও কুসংস্কারছন্নতা।

তার পাশাপাশি বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ অনেকদিন বিশ্বাস করতে চায়নি করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এনিয়ে দেশের রাষ্ট্রধর্মেরসহ অন্যান্য সম মর্জাদার ধর্মগুলোর ধর্মীয়গুরুরা নানানভাবে প্রপাগন্ডা চালিয়েছে যার রেশ আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি এবং তার সব’চে বড় উদহরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক হুজুরের জানাযায় হাজার হাজার মানুষের ঢল এবং করোনা প্রতিরোধে গ্রামে-গন্জে মানুষের অদ্ভুত সব কর্মকান্ড যা আপনারা অনেকিছুর শিকার ও প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী।

এবার আসা যাক মূল আলোচনায়।বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাবলিকদের আচার-আচরণ তাচ্ছিল্যপূণ্য এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অবহেলামূলক বটে। বেশিরভাগ সংবাদের বরাতে, কোন কাজ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ বাইরে ঘুরছে, লুকিয়ে লুকিয়ে ত্রেপাল দিয়ে ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গোপনে প্রবেশ করছে লকডাউন থাকার পরেও, ধর্মীয় অপব্যাখ্যার অজুহাতে জনসমাগম লেগেই আছে।

সুতরাং এসব রোধকল্পে সরকারের কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া এই পরিস্থিতিতে আর কোন পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না। কঠোর অবস্থানে যাওয়া মানে যথাযথ আইন প্রয়োগ করা। বাংলাদেশে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এবং সাধারণ মানুষকে বাধ্য করার জন্য যথেষ্ট আইন রয়েছে। বাংলাদেশের দন্ডবিধি-১৮৬০ হচ্ছে অপরাধের বর্ণনা ও শাস্তিবর্ণিত আইন।

এই আইনের অধ্যায়-১৪’তে বেশ কিছু ধারায় জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধানকল্পে করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতাবৃদ্ধি ব্যাবস্থা হিসেবে কিছু অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে, যা প্রয়োগ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

আপনাদের বোধগম্যের প্রসারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। দন্ডবিধির ২৬৯ ধারায় সংক্রামক রোগ নিয়ে অবহেলা করার অপরাধ ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ধারাটির গর্ভের বিস্তারিত হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি বেআইনীভাবে বা অবহেলামূলকভাবে এমন কোন কার্য করে যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোন রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করে, তবে সেই ব্যক্তি ছয়মাস পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

সুতরাং স্পষ্ট আলোচনা যে, করোনাভাইরাস এর মতো সংক্রামক রোগ নিয়ে অবহেলা একটি অপরাধ এবং এই ধারার প্রয়োগ বর্তমানে আমাদের জরুরী। এরপরে, ধারা ২৭০ এর আলোচনা হচ্ছে বিদ্বেষপরায়ন হয়ে সংক্রামক কোন রোগে আক্রান্ত কেউ সে রোগ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ করা।

এই ধারার গর্ভের আলোচনা হলো, কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন বিদ্বেষমূলক কার্য করে, যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোন রোগের সংক্রমণ বিস্তার করতে পারে, এবং সে কার্য করার দরুণ যে অনুরূপ রোগের সংক্রমণ বিস্তার হতে পারে তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ সত্ত্বেও তা করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

পাঠক এই দুইটি ধারার আরেকটি সুবিধা হলো এর বিচার প্রক্রিয়া অতি সহজ এবং দ্রুত। ধারা ২৬৯ ও ২৭০ এর অপরাধ আমলযোগ্য, মীমাংসার অযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং যেকোন জুডিশিয়াল মানে বিচারিক ম্যজিষ্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য। এই অধ্যায়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংক্রামক রোগ নিয়ে শেষ ধারা ২৭১, উক্ত ধারায় করোনাভাইরাসের ন্যায় সংক্রামক রোগ প্রতিরোধকল্পে মানুষকে আলাদা রাখা বা কোয়ারেন্টাইন নিয়ম অমান্য করার অপরাধ সম্পর্কে বলা আছে।

এই ধারার গর্ভের আলোচনা হলো, যেসব স্থানে সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে, সে সব স্থানের সাথে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ সম্পর্কে, সরকার দ্বারা প্রণীত ও জারীকৃত কোন বিধি বা নিয়ম কোন ব্যক্তি যদি জ্ঞাতসারে অমান্য করে, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

এই ধারার অপরাধ আমল অযোগ্য, জামিনযোগ্য ও মীমাংসাযোগ্য নয় তাছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্টেট এর বিচার করতে পারে। উল্লিখিত আলোচনা এবং আইনের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশের বর্তমানে চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দন্ডবিধির এই ধারাগুলোকে কার্যক্রর করা যেতে পারে এবং এতে করে মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইন বা ঘরে থেকে শারিরীক দুরত্ব মেনে চলায় বাধ্য করা অনেকাংশে সফল করা যেতে পারে।

পাঠক আরেকটি উল্লেখযোগ্য আলোচনা করা জরুরী। জেনে আনন্দিত হবেন যে, বাংলাদেশ সংসদ ২০১৮ সালে একটি আইন প্রণয়ণ করেন যা সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল)  আইন, ২০১৮ নামে পরিচিত। ২০১৮ সালের ৬১ নং আইনে ধারা ৪ আলোচনা করেছে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কোন কোন রোগগুলো সংক্রামক রোগ অর্থে অন্তর্ভুক্ত হবে। ধারা ৪(ঝ) অনুয়ায়ী এখানে মারস-কভ (MERS-CoV) ভাইরাস বা রোগকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাছাড়া ৪(ভ) ধারার বলা হয়েছে সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত (Emerging or Reemerging) রোগসমূহ এই আইনে প্রাধান্য পাবে।

সুতরাং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ও জনসমাগম রহিতকরণে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ এই আইনের প্রযোগে কোন বাধা নেই। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল)  আইনের ধারা ১১, ১৪, ১৭, ২৪, ২৫, ২৬ যথাক্রমে  বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজে লাগালে মানে এসব ধারার ভিত্তিতে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করলে নিঃসন্দেহে মানুষ পরিবর্তন হবে এবং হোম কোয়ারেন্টাইনসহ সরকারের অন্যান্য নির্দেশনা নিশ্চিত করা যাবে।

একই আইনের তফসিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার (WHO) আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রবিধান (International Health Regulations, 2005) কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা এই আইনের বর্তমান প্রয়োগকে আর কোনভাবেই প্রশ্নাতিত করতে পারেনা।

কি বুঝলেন পাঠক? উপরের সংক্ষিপ্ত আইনি আলোচনা ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে সহজে অনুমান করা যাবে যে বর্তমানে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতসহ জনগণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে উল্লিখিত আলোচনাকৃত আইনের নির্দিষ্ট ধারাসহ সংশ্লিষ্ট ধারার কার্যকর ব্যবহার এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।

অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
অ্যাডভোকেট শিপ্ত বড়ুয়া
শিপ্ত বড়ুয়া কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.বি(অনার্স) ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এলএল.এম সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অ্যাডভোকেট ও লিগ্যাল হোমে আইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। অনলাইনে আইনী পরামর্শ প্রদান ও সরাসরি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তিনি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য
আপনার নাম

আরও লেখা

যেভাবে আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিবেন

আইন পাশ করার পর একজন শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের জায়গায় থাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভূক্তি পরীক্ষা। দিন যত...

ফৌজদারী মামলায় জামিন যেভাবে পাওয়া যাবে

কোন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। কোন ফৌজদারী মামলায় জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে মনে...

সমাজসেবা অধিদপ্তরে সংস্থা/সংগঠন নিবন্ধনের নিয়ম

স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠন বা সংস্থাসমূহকে সরকারি নিবন্ধন দেওয়ার কাজ সমাজসেবা অধিদপ্তরের। আজকের লেখায় সংগঠন নিবন্ধন করার নিয়ম সম্পর্কে...

ফৌজদারী মামলায় আপিল করবেন যেভাবে

ফৌজদারী মামলায় আপিল সম্পর্কে আইনে সুর্নিদিষ্ট বিধান আছে। ধরুন ফৌজদারী মামলায় একটি রায় হলো, আপনি বাদী কিংবা বিবাদী...

You cannot copy content of this page