এই লেখায় আছে
জমি কেনার আগে আপনার দায়িত্ব
জমি কেনার আগে করণীয় কি সে নিয়ে আজকের আলোচনা। ভূমি ব্যবহারের ইতিহাস বেশ প্রাচীণ। হিন্দু, মুসলিম এবং ব্রিটিশ শাসনামল মিলে আজকের ভূমি আইন রচিত। যুগে যুগে ভূমি ব্যবহারের নানান নিয়ম এবং রীতি থেকে আমরা বর্তমানে আধুনিক এক আইন ব্যবস্থার ভোগদার হিসেবে আছি।
অস্থাবর সম্পত্তি এবং চিরস্থায়ী মালিকানা থাকার কারণে আমরা ভূ-সম্পত্তিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি । ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় একসময় ভূ-সম্পত্তি রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা চিরস্থায়ীভাবে ভোগ কিংবা হস্তান্তর করতে পারতো না। সময়ের পালাক্রমে নানান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নাগরিক এখন সম্পত্তির ৯৯% মালিক হতে পারছে। এটা সুখবর বৈকি।
আজকের লেখাটি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যদি আপনি জমি কেনার চিন্তা করে থাকেন অথবা ইতিমধ্যেই কিনে থাকেন। জমি ক্রয়ের আগে এবং পরে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে আজীবন নিশ্চিন্তে থাকা যায়।
জমি ক্রয়ের পূর্বে প্রথমেই আপনাকে যে বিষয়টি দেখতে হবে তা হলো জমিটি যে বিক্রি করতে চাচ্ছে সে আসল মালিক কিনা, এবং আইন অনুযায়ী সম্পত্তিটি বিক্রয় করার অধিকার তার আছে কিনা।
এসব যাচাই করার জন্য আপনাকে বিক্রেতার নিকট হতে জমির দলিল, খতিয়ান এবং পর্চার ফটোকপি সংগ্রহ করতে হবে এবং এসব নিয়ে পর্যায়ক্রমে রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস ও সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়ে যাচাই করতে হবে এসকল ডকুমেন্টস সঠিক আছে কিনা।
এখানে একটি বিষয় জরুরি যে, খতিয়ান যাচাই করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে সর্বশেষ খতিয়ান বিক্রেতার নামে আছে কিনা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি হলে খতিয়ান পূর্ব পুরুষদের নামে আছে কিনা।
এসব বিষয় আপনাকে যাচাই করতে হবে কারণ বাংলাদেশ সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩সি ধারাতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর/বিক্রয় করতে পারবে না, যদি সে উত্তরাধিকারী হওয়া ব্যতীত অন্য কোনভাবে উক্ত সম্পত্তির মালিক হন, কিংবা তাঁর পূর্বপুরুষগণের নাম বা তিনি উত্তরাধিকারী তাঁর সর্বশেষে খতিয়ানভূক্ত, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর অধীনে হতে হবে- অন্যকোনভাবে হস্তান্তর হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
সুতরাং, বিক্রেতার কিংবা তাঁর পূর্বপুরুষদের নামীয় খতিয়ান ছাড়া বিক্রি বে-আইনী। বিক্রেতার নিজের নামে সম্পত্তি হলে খতিয়ান দেখে তা তো কিনতে পারলেন কিন্তু যেক্ষেত্রে ওয়ারিশানসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি কেউ বিক্রি করতে চাইবে সেক্ষেত্রে অবশ্যেই যাচাই করে দেখবেন যে, মৃত ব্যক্তির মোট ওয়ারিশান কত জন আছেন।
এটা একারণেই যাচাই করে দেখতে মৃত ব্যক্তি একাধিক ওয়ারিশ রেখে যেতে পারেন এবং বিক্রেতার জমি কতটুকু বিক্রয়ের অধিকার আছে। অনেক সময় প্রাপ্ত অংশের বেশি বিক্রয় করে দেন অসাধু বিক্রেতারা, পরে স্বাভাবিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হন ক্রেতা।
এসব দেখা হয়ে গেলে একটি জমির মূল মালিকানা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এরপরেও জমি ক্রয়ের আগে আপনাকে আরো কিছু বিষয় নজরে আনতে হবে। দলিল, খতিয়ান ঠিক থাকলে সর্বশেষ হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ আছে কিনা যাচাই করুন।
যদি খাজনা ইতিমধ্যেই প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে দাখিলা রশিদ অবশ্যই যাচাই করবেন। জমি স্থাবর সম্পত্তি এবং কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও ক্রয়ের আগে জমির দখল কার আছে তা দেখবেন,
বিক্রেতার যদি জমিতে দখল না থাকে সে জমি ক্রয় করে লাভ নেই কারণ জমি দখলে যাওয়া বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে খুব কঠিন।
এরপর, যে বিষয়টি আপনাকে সতর্কতার সাথে দেখতে হবে তা হলো বিক্রেতা জমিটি অন্যকারো সাথে বিক্রয় চুক্তি কিংবা বায়নানামা করেছে কিনা। এটা জানার জন্য আপনি রেজিষ্টি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন, কারণ সকল প্রকার বায়নানামা রেজিষ্ট্রি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে রেজিষ্ট্রেশন আইনে।
সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩বি ধারা অনুযায়ী যতক্ষণ পর্যন্ত কোন স্থাবর সম্পত্তি কোন বায়না চুক্তির অধীন থাকে কিংবা বায়না চুক্তির কার্যকর থাকে, যদি না তা আইনাানুগভাবে বাতিল না করা হয় তা হলে যে কোন হস্তান্তর করা হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিকগণ প্রথমে এক পক্ষের সাথে জমি বিক্রয়ের বায়না করে পরবর্তীতে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে বেশী দামে অপর পক্ষের নিকট বিক্রি করে দেয়, সেকারণে জমি ক্রয়ের আগে এসব বিষয় পর্যালোচনা জরুরী।
এসব বিষয় দেখা হয়ে গেলে দেখতে হবে যে বিক্রেতার সম্পত্তিটি কোন ব্যংক বা প্রতিষ্টান কিংবা ব্যক্তির নিকট বন্ধক আছে কিনা। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩ডি ধারা অনুযায়ী কোন স্থাবর সম্পত্তি যদি কোন বন্ধকী দলিলের অধীনে নিবন্ধিত/রেজিষ্ট্রিকৃত থাকে, তা হলে উক্ত সম্পত্তি উক্ত বন্ধক গ্রহীতার লিখিত সম্মতি ব্যতিরেকে পুনরায় বন্ধক কিংবা বিক্রয় করা যাবে না এবং এর অন্যথায় করা হলেও উক্ত বন্ধক বা বিক্রি বাতিল বলে গণ্য হবে।
এক্ষেত্রে আপনার প্রশ্ন হাতে পারে এসব বিষয় কিভাবে যাচাই করবেন? এজন্য বিক্রেতার জমিতে ক্রয়ের পূর্বে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া যেতে পারে। রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুযায়ীও বন্ধকী দলিল রেজিষ্ট্রি করা বাধ্যতামূলক।
উপরে উল্লিখিত সবকিছু বিষয় যাচাই করা হয়ে গেলে এবং ঠিকঠাক থাকলে এবার আপনি জমি ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। আমার পরামর্শ থাকবে জমি ক্রয়ের আগে আপনি নিজে তথ্য-উপাত্ত দেখার পরে একজন বিজ্ঞ সিভিল ল’ইয়ারকে জমির সকল দলিলপত্র দেখান এবং পরামর্শ নিন।
তারপরেই চলে যান রেজিষ্ট্রি অফিসে এবং অভিজ্ঞ একজন দলিল লেখককে দিয়ে সাফ-কবলা দলিল প্রস্তুত করান এবং অবশ্যই তা বার বার বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বারা সমর্থন করিয়ে নিন। জমি কিনবেন আপনি দায়িত্ব আপনারই। উপরে উল্লিখিত বিষয়াদি যদি যাচাই না করে ভূমি কিনেন তাহলে হয়তো ভোগান্তি আপনার সঙ্গী হয়ে যাবে।
জমির দলিল রেজিষ্ট্রি হয়ে গেলে আপনার দায়িত্ব
মনে রাখতে হবে দলিল-পত্র সব ক্লিয়ার হয়ে গেলে আপনার জমি ক্রয় সমাপ্ত নয়। আগেই বলেছি জমির দখল নিয়ে। রেজিষ্ট্রি হওয়ার পর একজন অভিজ্ঞ আমিন দিয়ে রেজিষ্ট্রিকৃত জায়গটির দখল মেপে বুঝে নিন এবং সীমানা পিলার দিয়ে দিন। জমির দখল প্রতিষ্ঠার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করুন।
রেজিষ্ট্রি দলিলের সার্টিফাইড নকল পাওয়ার পর দেরী না করে অবশ্যই সহকারী ভূমি কমিশনার অফিসে গিয়ে মিউটেশন/নামজারীর জন্য আবেদন করুন। নামজারীর জন্য বর্তমানে অনলাইনেও আবেদন করা যায়। দ্রুত নামজারী করা জরুরী কারণ অনেক বিক্রেতা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে একই জমি বার বার বিক্রি করে থাকেন।
নামজারী যদি হয়ে যায় নামজারী খতিয়ান এবং ডি.সি.আর সংগ্রহপূর্বক নতুন হোল্ডিং এ খাজনা পরিশোধ করুন এবং দাখিলা সংরক্ষণ করুন।
জমি ক্রয়ের আগে এবং পরে অবশ্যই উপরের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা জরুরী। আপনি উক্ত নিয়ম মেনে জমি ক্রয় করলে অজীবন নিশ্চিন্তে ভূমির নিরবিচ্ছিন্ন ব্যবহার করতে পারবেন।
- তথ্যসূত্র : ১. এডভোকেট জওহরলাল দাস, বাংলাদেশের ভূমি আইন। ২. সৈয়দ হাসান জামিল, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন। ৩. ড. এল কবির, ল্যান্ড লজ অব বাংলাদেশ।
[…] জমি কেনার আগে ও পরে যা জানা জরুরী […]